সত্যজিৎ দাস:
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রভাবশালী কবি,শিল্পী ও চিন্তক নির্মলেন্দু গুণের আজ ৮০তম জন্মদিন। ১৯৪৫ সালের ২১ জুন নেত্রকোণার বারহাট্টা উপজেলার কাশবন গ্রামে জন্ম নেওয়া এই কবি বাংলা সাহিত্যে নিজস্ব কাব্যভঙ্গি ও স্পষ্ট বক্তব্যের জন্য সুপরিচিত।
পুরো নাম নির্মলেন্দু প্রকাশ গুণ চৌধুরী। তার বাবা সুখেন্দুপ্রকাশ গুণ এবং মা বীণাপাণি। মাত্র চার বছর বয়সেই মাতৃহারা হন তিনি। ছেলেবেলা কেটেছে গ্রামের কাশবনের সবুজ প্রকৃতির মধ্যেই। সেই গ্রামীণ জীবন ও স্বাধীনতার উত্তাল সময়ই তার কাব্যচেতনার মূল প্রেরণা।
তিনি শিক্ষাজীবন শুরু করেন বারহাট্টার করোনেশন কৃষ্ণপ্রসাদ ইনস্টিটিউট থেকে। পরে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন। মেট্রিকে দুই বিষয়ে লেটার পেয়ে প্রথম বিভাগ অর্জনকারী এই কবি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসি বিভাগে সুযোগ পেলেও অর্থাভাবে ভর্তি হতে পারেননি।
মেট্রিক পরীক্ষার আগেই ‘উত্তর আকাশ’ পত্রিকায় তার প্রথম কবিতা ‘নতুন কাণ্ডারি’ প্রকাশিত হয়। এরপর আর থেমে থাকেননি। একে একে তিনি হয়ে উঠেছেন স্বাধীনতা, প্রেম ও দ্রোহের কণ্ঠস্বর।
নির্মলেন্দু গুণের কবিতায় স্পষ্ট প্রতিবাদ,প্রেমিক হৃদয় এবং স্বদেশের প্রতি গভীর ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে।
১৯৭০ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’, যা তার সাহিত্যজীবনে মাইলফলক হয়ে ওঠে। এই গ্রন্থের ‘হুলিয়া’ কবিতা ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে,যার উপর ভিত্তি করে তানভীর মোকাম্মেল নির্মাণ করেন একটি চলচ্চিত্র।
তার আরেকটি বহুল আলোচিত কবিতা ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ দেশের মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তকেও অন্তর্ভুক্ত। এই কবিতা তাকে এনে দেয় জনপ্রিয়তা ও পাঠকের ভালোবাসা।
বাংলা সাহিত্যে তার অসামান্য অবদানের জন্য তিনি পেয়েছেন:
১) ১৯৮২ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার।
২) ২০০১ সালে একুশে পদক।
৩) ২০১৬ সালে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান স্বাধীনতা পুরস্কার।
নির্মলেন্দু গুণ শুধু কবিতার মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। অবসরে তুলির আঁচড়ে চিত্রাঙ্কন করেছেন বরাবর। ২০০৯ সালে জাতীয় গ্রন্থাগারের সামনেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল তার চিত্রপ্রদর্শনী।
এক সাক্ষাৎকারে কবি বলেন,“আমি নিজেই আমার জন্মদিন ভুলে যাই। আমি কখনোই নিজের জন্মদিন ঘটা করে পালন করি না। তবে জন্মদিন নিয়ে আমার লেখা সবচেয়ে বড় কবিতাটি হলো ‘৭ই আষাঢ়’। এতো বড় জন্মদিনভিত্তিক কবিতা বাংলা সাহিত্যে খুব কমই আছে।”
আর নিজের সহজ প্রকাশভঙ্গি সম্পর্কে তিনি বলেন,“আমার যা বলবার স্পষ্ট করেই বলি। চারপাশের কঠিনের ভিড়ে আমি সহজ করে বলতে জানি,তাতেই আনন্দ।”
তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে:
‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’, ‘হুলিয়া’, ‘অমীমাংসিত রমণী’, ‘চৈত্রের ভালোবাসা’, ‘তার আগে চাই সমাজতন্ত্র’, ‘চাষাভুষার কাব্য’, ‘পৃথিবীজোড়া গান’, ‘দূর হ দুঃশাসন’, ‘নিরঞ্জনের পৃথিবী’, ‘চিরকালের বাঁশি’, ‘দুঃখ করো না, বাঁচো’ ইত্যাদি।
পাশাপাশি তিনি লিখেছেন আত্মজীবনীমূলক রচনা, ভ্রমণকাহিনী,প্রবন্ধ এবং সামাজিক-রাজনৈতিক বিশ্লেষণমূলক গদ্য।