বাংলাদেশের বিমানবন্দরগুলোতে যাত্রীদের তথ্য ব্যবস্থাপনায় যুক্ত হয়েছে নতুন একটি প্রযুক্তি প্রকল্প, যেটি পরিচালনায় রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ‘এমিরেটস টেকনোলজি সলিউশনস (ইটেক)’। তবে এই প্রকল্প ঘিরে উঠেছে স্বার্থের সংঘাত ও দুর্নীতির প্রশ্ন। কারণ, পুরো ব্যবস্থার একটি অংশ পেয়েছে দুবাইভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘আইডেন্টিমা’, যার ৩৪ শতাংশ মালিকানা রয়েছে ঢাকায় নিযুক্ত আমিরাতের রাষ্ট্রদূত আবদুল্লাহ আলি আলহামুদি’র। একইসঙ্গে, তিনি প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন।
২০২১ সালে আলহামুদি যখন বাংলাদেশে আমিরাত দূতাবাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদে ছিলেন (চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স), সেই সময়ই আইডেন্টিমা কোম্পানিটি গড়ে তোলা হয়। পরের বছর, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ও আমিরাতের মধ্যে একটি চুক্তি সই হয় যাত্রী তথ্য ব্যবস্থাপনার জন্য, যার অধীনেই এই বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানটি কাজ পায়।
আইডেন্টিমার বাকি দুই অংশীদার হলেন বাংলাদেশি নাগরিক মুনতাসির বিল্লা শাহরিয়ার ও সাজেদ আহম্মাদ সামি—প্রত্যেকে ৩৩ শতাংশ শেয়ারের মালিক। শাহরিয়ার সম্পর্কে অভিযোগ রয়েছে, তিনি ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ছিলেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, আইডেন্টিমা বা ইটেকের এরকম কোনো প্রকল্পে পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই, তবুও তারা এই গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নিরাপত্তা-সম্পর্কিত কাজ পেয়ে যায়।
পরবর্তীতে আইডেন্টিমা আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান ‘সিটা’র সঙ্গে চুক্তি করে যাত্রীদের তথ্য ব্যবস্থাপনা পরিচালনার জন্য। কিন্তু এই সফটওয়্যার ব্যবহারে বাংলাদেশ সরকারকে প্রতি যাত্রীপ্রতি ৬.৫০ ডলার ফি পরিশোধ করতে বলা হয়, যা পরে ৪ ডলারে নামানো হয়। অথচ, আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা (আইসিএও) সর্বোচ্চ ৩.৫০ ডলারের সুপারিশ করে থাকে। আরও আশ্চর্য, আমিরাত নিজের দেশে একই প্রতিষ্ঠানের কাছে এই সেবার জন্য মাত্র ১.৫০ ডলার ফি দিচ্ছে।
এই উচ্চ ফি’র বোঝা শেষ পর্যন্ত বহন করতে হচ্ছে সাধারণ যাত্রীদের, বিশেষ করে বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের, যাদের অনেকেই মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত। বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, রাষ্ট্রদূতের ব্যবসায়িক সম্পৃক্ততা একটি সরাসরি স্বার্থের সংঘাত এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের নজির। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “রাষ্ট্রদূতের মতো একজন সরকারি কর্মকর্তা সরকারের অনুমোদন ছাড়া কোনো বাণিজ্যিক কার্যক্রমে যুক্ত হতে পারেন না। এই বিনিয়োগের অর্থ কোথা থেকে এসেছে, তাও তদন্ত সাপেক্ষ বিষয়।”
এই প্রকল্পকে ঘিরে একদিকে রয়েছে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা, অন্যদিকে রয়েছে কূটনৈতিক শিষ্টাচার এবং স্বচ্ছতার প্রশ্ন—যা এখন জাতীয় বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে।