বাংলাদেশের সমুদ্র অঞ্চলে ব্যাপক পরিমাণ খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। অগভীর ও গভীর সমুদ্রের তলদেশে ইউরেনিয়াম ও থোরিয়ামের মতো মূল্যবান খনিজ পাওয়া গেছে। অগভীর সমুদ্রে ক্লে পাওয়া গেছে, যা সিমেন্ট উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া বঙ্গোপসাগরের ১৩টি স্থানে ইলমেনাইট, গার্নেট, সিলিমানাইট, জিরকন, রুটাইল ও ম্যাগনেটাইট সমৃদ্ধ ভারি খনিজ বালু পাওয়া গেছে। দেশের সমুদ্র ভাগেও গ্যাস মজুত রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করছেন, বঙ্গোপসাগর থেকে বছরে প্রায় আড়াই লাখ কোটি ডলারের সম্পদ আহরণ সম্ভব, কিন্তু বর্তমানে দেশ মাত্র ৯৬০ কোটি ডলারের সম্পদ আহরণ করছে।
বিশেষজ্ঞরা আরও জানিয়েছেন, বঙ্গোপসাগরে তেল, গ্যাস, চুনাপাথরসহ আরও ১৭ ধরনের খনিজ বালু পাওয়া গেছে। এসব থেকে লেড, জিংক, কপার, কোবাল্ট, মলিবডেনের মতো দুর্লভ ধাতু আহরণ সম্ভব, যা উড়োজাহাজ, রাসায়নিক কারখানা ও কলকারখানায় ব্যবহার করা যাবে। বাংলাদেশের সমুদ্র সম্পদের বর্তমান অবদান দেশের অর্থনীতিতে মাত্র ৬ শতাংশ।
সরকার ব্লু-ইকোনোমি খাতকে এগিয়ে নিতে ৯টি খাতে কাজ করছে। গতবছর গবেষণায় বঙ্গোপসাগরের একান্ত অঞ্চলে বিভিন্ন উদ্ভিজ ও প্রাণিজ সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে। যুক্তরাজ্য ও নেদারল্যান্ডসের সহযোগিতায় পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় বিপুল পরিমাণ গ্যাস হাইড্রেট, ২২০ প্রজাতির সি-উইড, ৩৪৭ প্রজাতির মাছ, ৪৯৮ প্রজাতির ঝিনুক, ৫২ প্রজাতির চিংড়ি, ৫ প্রজাতির লবস্টার, ৬ প্রজাতির কাঁকড়া এবং ৬১ প্রজাতির সি-গ্রাস রয়েছে।
জলসীমার গুরুত্ব:
দেশের অর্থনৈতিক জলসীমা (EEZ) প্রায় ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।
এই এলাকায় মাছ ধরা, তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান, মেরিন খনিজ, এবং সমুদ্র জ্বালানি সম্পদ আহরণের অধিকার থাকে।
সম্ভাব্য খনিজ সম্পদ:
তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস: সমুদ্রের তলদেশে মজুদ।
ম্যাঙ্গানিজ, কয়লা, কপার, লোহা ইত্যাদি: গভীর সমুদ্রের তলদেশে পাওয়া যায়।
ডায়মন্ড বা রেয়ার আর্থ এলিমেন্টস: বিশেষজ্ঞরা আবিষ্কারের জন্য গবেষণা চালাচ্ছেন।
আর্থিক সম্ভাবনা:
যদি এ ধরনের সম্পদ শোধন, উত্তোলন এবং বাজারজাতকরণ সঠিকভাবে করা যায়, তাহলে উল্লেখিত ২.৫ লাখ কোটি ডলার বা তারও বেশি বার্ষিক আয় সম্ভাব্য।
তবে এর জন্য প্রয়োজন: প্রযুক্তি, দক্ষ মানবসম্পদ, বিনিয়োগ, পরিবেশ রক্ষা এবং আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলা।
চ্যালেঞ্জ:
গভীর সমুদ্র থেকে খনিজ আহরণ অত্যন্ত ব্যয়বহুল।
পরিবেশগত প্রভাব, বিশেষ করে সমুদ্র экোসিস্টেমের উপর, গুরুত্বপূর্ণ।
আন্তর্জাতিক জলসীমা আইন (UNCLOS) মেনে চলা জরুরি
২০১৪ সালের পর সমুদ্র বিজয়ের পর স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। দেশের এক্সক্লুসিভ ইকোনোমিক জোনে বাণিজ্যিকভাবে টুনা ও অন্যান্য বড় মাছ আহরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ইন্ডিয়ান ওশেন টুনা কমিশনের পূর্ণাঙ্গ সদস্যপদ লাভ করেছে। এছাড়া বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ ও ইকোসিস্টেমের সংরক্ষণ, নিয়মিত তদারকি ও জেলেদের জীবনমান উন্নয়নের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
বঙ্গোপসাগরের তলদেশ থেকে আহরণযোগ্য খনিজ পদার্থের মধ্যে ক্লেসার ডেপোজিট, ফসফরাস ডেপোজিট, এডাপোরাইট, পলিমেটালিক সালফাইড ও মাঙ্গানিজ নডিউল রয়েছে। সঠিকভাবে উত্তোলন ও পরিশোধনের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। গভীর সমুদ্রবন্দর ও আধুনিক বন্দরের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্লু-ইকোনমি সমৃদ্ধ করতে হলে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার, দূষণ নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ সংরক্ষণ, গবেষণা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং জনসচেতনতা একসাথে কার্যকর করা জরুরি। সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগর শুধু অর্থনীতির চালিকা শক্তি নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও সমৃদ্ধ সম্পদভাণ্ডার হয়ে থাকবে।







