ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সম্পর্ক শুরু থেকেই জটিল ছিল, তবে এটি এক পর্যায়ে পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। হোয়াইট হাউসে হওয়া উত্তপ্ত বৈঠকের পর এই সম্পর্ক আরও অবনতির দিকে গিয়েছিল। এর ফলে শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্র-ইউক্রেন সম্পর্কই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, বরং ন্যাটো এবং ইউরোপীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন ইউক্রেনের প্রতি তার নীতি বেশিরভাগ সময় অনিশ্চিত ছিল। প্রথমদিকে, তিনি ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দিয়েছিলেন, তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার অবস্থান পরিবর্তিত হতে থাকে। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে ট্রাম্প এবং জেলেনস্কির একটি ফোনালাপ আন্তর্জাতিকভাবে বিতর্কের জন্ম দেয়। ট্রাম্প ইউক্রেনের উপর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন যাতে তারা জো বাইডেন ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। এই ইস্যু নিয়ে মার্কিন কংগ্রেসে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিশংসন প্রক্রিয়াও শুরু হয়।
এই সম্পর্ক আরও খারাপের দিকে মোড় নেয় যখন জেলেনস্কি প্রকাশ্যে বলেন যে, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে প্রত্যাশিত সমর্থন পাচ্ছেন না। ট্রাম্পের প্রশাসন ইউক্রেনকে অস্ত্র সহায়তা দিতে গড়িমসি করেছিল, যা ইউক্রেনের সামরিক সক্ষমতার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।
যুক্তরাষ্ট্র-ইউক্রেন সম্পর্কের অবনতি
ট্রাম্প প্রশাসন ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দিতে দ্বিধান্বিত ছিল, যা রাশিয়ার প্রতি তার নীতির প্রতিফলন ছিল। তিনি বরাবরই রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পক্ষে ছিলেন এবং এর অংশ হিসেবে ইউক্রেনকে কম সহায়তা দেওয়ার কৌশল গ্রহণ করেছিলেন।
ট্রাম্পের এই নীতির ফলে ইউক্রেনীয় নেতৃত্ব বিশেষ করে জেলেনস্কির অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে। ইউক্রেনের কর্মকর্তারা তখন ইউরোপীয় মিত্রদের দিকে আরও বেশি ঝুঁকে পড়তে শুরু করেন। বিশেষ করে, জার্মানি ও ফ্রান্সের কাছ থেকে কূটনৈতিক সমর্থন পাওয়ার চেষ্টা চলতে থাকে।
যুক্তরাষ্ট্র যদি ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা বন্ধ করে দেয়, তাহলে ইউক্রেনের সবচেয়ে বড় ভরসা হবে ইউরোপীয় দেশগুলো। পোল্যান্ড, বাল্টিক রাষ্ট্রগুলো এবং যুক্তরাজ্য ইতোমধ্যে ইউক্রেনকে ব্যাপক সহায়তা দিয়েছে। তবে জার্মানি এবং ফ্রান্সের অবস্থান কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত। তারা রাশিয়ার সঙ্গে সংঘাতে না জড়ানোর জন্য কূটনৈতিক সমাধান খোঁজার চেষ্টা করছে।
ইউরোপীয় মিত্ররা যদি যুক্তরাষ্ট্রের ঘাটতি পূরণ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে ইউক্রেনের সামরিক প্রতিরক্ষা দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। এটি রাশিয়ার জন্য কৌশলগত সুবিধা তৈরি করবে, যা ইউরোপের নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি সৃষ্টি করবে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বরাবরই ইউক্রেনকে একটি কৌশলগত অঞ্চল হিসেবে দেখে এসেছেন। তিনি চাইছেন ইউক্রেনকে ন্যাটোর হাত থেকে দূরে রাখতে। ট্রাম্প প্রশাসনের ইউক্রেন নীতির পরিবর্তন রাশিয়াকে কূটনৈতিক ও সামরিকভাবে আরও আক্রমণাত্মক হতে উত্সাহিত করেছে।
তবে, রাশিয়াও বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। দীর্ঘ যুদ্ধের ফলে তাদের বিশাল মানবসম্পদ ও সামরিক সরঞ্জাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে, তারা কৌশলগতভাবে কিছুটা দুর্বল অবস্থানে রয়েছে। যদি ইউক্রেন শক্তিশালী মিত্রদের সমর্থন ধরে রাখতে পারে, তাহলে তারা প্রতিরোধ চালিয়ে যেতে পারবে।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
১. যুক্তরাষ্ট্রের নীতি পরিবর্তন: যদি ট্রাম্প পুনরায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তাহলে ইউক্রেনের জন্য আরও কঠিন সময় আসতে পারে। তিনি রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চাইলে ইউক্রেনের প্রতি তার অবস্থান আরও শিথিল হতে পারে। ২. ইউরোপের ভূমিকা:ইউক্রেনের জন্য মূল প্রশ্ন হল—ইউরোপীয় মিত্ররা কি যথেষ্ট সহায়তা দিতে পারবে? যদি তারা সফল হয়, তাহলে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বজায় থাকবে। ৩. রাশিয়ার সামরিক শক্তি: রাশিয়া যদি যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সক্ষম হয় এবং ইউক্রেনের ওপর সামরিক চাপ বাড়ায়, তাহলে ইউক্রেনের জন্য পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে উঠবে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ভলোদিমির জেলেনস্কির সম্পর্ক শুধু দুই নেতার মধ্যকার দ্বন্দ্ব নয়, বরং এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। যুক্তরাষ্ট্রের নীতি পরিবর্তন হলে ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে, এবং এর ফলে ইউরোপীয় নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়বে। ইউক্রেনের টিকে থাকার জন্য ইউরোপীয় মিত্রদের দৃঢ় প্রতিশ্রুতি থাকা অত্যন্ত জরুরি।