২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে গাজা উপত্যকার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। ইসরায়েলি বাহিনী পুরোপুরি ঘিরে ফেলেছে দক্ষিণ গাজার রাফাহ শহরকে, যা এতদিন বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে বিবেচিত ছিল। এই ঘেরাওয়ের ফলে রাফাহ শহর কার্যত গাজার অন্যান্য অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ইসরায়েল দাবি করছে, এটি তাদের ঘোষিত “নিরাপত্তা অঞ্চল” পরিকল্পনার অংশ, যার মাধ্যমে তারা হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করছে। তবে বাস্তবে এই পদক্ষেপের ফলে শহরটির লাখ লাখ সাধারণ অধিবাসী, যাদের অনেকেই আগেই গাজা সিটির ধ্বংসযজ্ঞ থেকে পালিয়ে এসেছিলেন, এবার সম্পূর্ণরূপে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন।
মানবিক সংকটের চূড়ান্ত রূপ
জাতিসংঘের এক জ্যেষ্ঠ মানবিক কর্মকর্তার মতে, ইসরায়েলের তরফ থেকে জল সরবরাহ ব্যবস্থা লক্ষ্য করে আক্রমণ এবং মেরামত কাজ বন্ধ রাখার কারণে গাজায় “একেবারে বিপর্যয়কর মানবিক অবস্থা” সৃষ্টি হয়েছে। শহরগুলোতে পানির অভাবে মানুষ দূষিত পানি পান করছে, যার ফলে ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। সেই সঙ্গে বিদ্যুৎহীন হাসপাতালগুলিতে চিকিৎসা কার্যক্রম প্রায় অচল হয়ে গেছে।
প্রাণহানির সর্বশেষ পরিসংখ্যান
- গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ইসরায়েলের হামলায় এ পর্যন্ত ৫০,৯১২ জন নিহত হয়েছেন এবং ১,১৫,৯৮১ জন আহতহয়েছেন।
- গাজা সরকারের গণমাধ্যম অফিস এর তথ্য মতে, মোট ৬১,৭০০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন, কারণ হাজার হাজার মানুষ এখনও ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছেন এবং তাদের মৃত বলে গণ্য করা হচ্ছে।
- এই নিহতদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী ও শিশু। জাতিসংঘের বিশ্লেষণ বলছে, মার্চ ১৮ থেকে এপ্রিল ৯-এর মধ্যে ইসরায়েলি বাহিনীর চালানো অন্তত ৩৬টি বিমান হামলায় কেবলমাত্র নারী ও শিশু নিহত হয়েছে।
“নিরাপদ অঞ্চল” নামেই শুধু
ইসরায়েল কর্তৃক ঘোষিত তথাকথিত “নিরাপদ অঞ্চল”, যেমন আল-মাওয়াসি এলাকার শরণার্থী তাঁবুগুলিতেও বিমান হামলা চালানো হয়েছে। এতে বহু নিরীহ বেসামরিক লোক হতাহত হয়েছেন। খান ইউনিসের কিজান আন-নাজ্জার এলাকায় চালানো ড্রোন হামলায় আরও একজন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। উত্তর গাজার আল-আতারাতে এবং গাজার তুফফাহ এলাকায় বোমা বর্ষণে বহু শিশু আহত হয়েছে, কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে।
আল-আহলি হাসপাতালে কর্মরত আল জাজিরার সাংবাদিক হিন্দ খুদারির এক হৃদয়বিদারক প্রতিবেদনে জানা গেছে, একটি নবজাতক মেয়ে শিশুর নাম ছিল শাম। এক বিমান হামলায় তার পুরো পরিবার ধ্বংস হয়ে যায়, সে নিজেও গুরুতর আহত হয়। হাত কেটে ফেলতে হয়, এবং কয়েক ঘণ্টা পরে তার মৃত্যু হয়।
হামাসের বিরুদ্ধে অভিযানের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ইসরায়েল দাবি করেছে যে, তারা কেবল সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকেই লক্ষ্যবস্তু করছে। কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। অধিকাংশ হতাহতই সাধারণ নারী ও শিশু। আন্তর্জাতিক মহলের নিন্দা সত্ত্বেও ইসরায়েল তার আগ্রাসন বন্ধ করেনি। মানবাধিকার সংস্থাগুলো একে গণহত্যার সামিল বলছে।
৭ অক্টোবর ২০২৩ সালে হামাসের এক সমন্বিত হামলায় ইসরায়েলে ১,১৩৯ জন নিহত হন এবং ২০০ জনেরও বেশি লোককে অপহরণ করা হয়। সেই হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল গাজায় পূর্ণাঙ্গ সামরিক অভিযান শুরু করে। যুদ্ধের এই ধারাবাহিকতায় গাজার প্রায় প্রতিটি শহর ধ্বংস হয়ে গেছে।
বর্তমান পরিস্থিতি এক নিখাদ মানবিক বিপর্যয়ে পরিণত হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, রাফাহে ঘেরাও এবং অমানবিক বোমাবর্ষণ যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে এটা ২১শ শতাব্দীর অন্যতম বড় গণহত্যার উদাহরণ হিসেবে ইতিহাসে স্থান পেতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ এবং হস্তক্ষেপ ছাড়া এই সংকট থেকে উত্তরণের আশা খুবই ক্ষীণ। গাজার ভবিষ্যৎ এখন গুলির শব্দ আর ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে।