যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনার মরুভূমিতে দাঁড়িয়ে থাকা কাঁচে মোড়ানো ভবন ‘বায়োস্ফিয়ার ২’ আধুনিক বিজ্ঞানের এক উচ্চাভিলাষী কিন্তু বিতর্কিত অধ্যায়। ১৯৯১ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্পে আটজন মানুষ পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নভাবে একটি কৃত্রিম বাস্তুতন্ত্রে দুই বছর ধরে টিকে থাকার চেষ্টা করেন। লক্ষ্য ছিল—পৃথিবীর বাইরে, যেমন মঙ্গল বা চাঁদে, ভবিষ্যতের বসবাসযোগ্য পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব কি না, তা যাচাই করা। বিশাল কাঁচঘেরা এই গম্বুজে ছিল রেইনফরেস্ট, মরুভূমি, সমুদ্র, জলাভূমি এবং চাষাবাদের জন্য জায়গা। তারা নিজেরা খাদ্য উৎপাদন করতেন, অক্সিজেন তৈরি করতেন এবং বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে জীবন চালাতেন।
কিন্তু বাস্তবতা ছিল কঠিন। কিছু মাসের মধ্যেই সেখানে অক্সিজেনের মাত্রা বিপজ্জনকভাবে কমে যায়, শ্বাসকষ্ট, মাথাব্যথা, ক্লান্তিতে ভোগেন অংশগ্রহণকারীরা। বাধ্য হয়ে বাইরের অক্সিজেন সরবরাহ করতে হয়, যা প্রকল্পের স্বনির্ভরতার মূল দর্শনের বিরোধী। অতিরিক্ত জীবাণুসমৃদ্ধ মাটি অক্সিজেন শুষে নিয়ে কার্বন ডাই-অক্সাইড তৈরি করছিল, অথচ অভ্যন্তরীণ উদ্ভিদ সেই গ্যাস প্রক্রিয়াজাত করতে পারছিল না। পরাগবাহী পোকামাকড়ের বিলুপ্তি, খাদ্য উৎপাদনের ব্যর্থতা ও মানসিক চাপ প্রকল্পটিকে আরও বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়। দৈনিক ক্যালোরি কমে যাওয়ায় শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে, বাসিন্দারা ওজন হারান।
সমালোচকরা একে একসময় ‘বিজ্ঞানের নাটক’ বলেও আখ্যা দিয়েছিলেন। তবে বায়োস্ফিয়ার ২ থেকে পাওয়া শিক্ষা আজও মূল্যবান। এটি দেখিয়েছে, পৃথিবীর জটিল বাস্তুতন্ত্রের বিকল্প তৈরি করা কতটা দুঃসাধ্য। কৃত্রিম পরিবেশে মানুষের টিকে থাকার খরচ ও অনিশ্চয়তা ভয়াবহ রকম বেশি। তাই যখন ধনকুবেররা মহাকাশে বসবাসের স্বপ্ন দেখেন, তখন বায়োস্ফিয়ার ২ আমাদের মনে করিয়ে দেয়—পৃথিবীই শ্রেষ্ঠ আশ্রয়। বর্তমানে এটি অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ গবেষণাকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তন ও ভবিষ্যতের টেকসই পরিবেশ নিয়ে গবেষণা চলছে। এই ব্যর্থতাই আমাদের শিখিয়েছে, প্রকৃতিকে জয় করার চেয়ে তার সঙ্গে সহাবস্থান করাই ভবিষ্যতের পথ।