২০১৮ সালে প্রথম আবিষ্কৃত ‘ড্রাগন ম্যান’ খুলির প্রকৃত পরিচয় দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞানীদের জন্য এক রহস্য ছিল। তবে সম্প্রতি এক যুগান্তকারী গবেষণায় জানা গেছে, এই রহস্যময় খুলি আসলে ডেনিসোভান নামে পরিচিত এক বিলুপ্ত প্রাচীন মানব প্রজাতির অন্তর্গত। ডেনিসোভানরা প্রায় ২ লক্ষ ১৭ হাজার বছর আগে পৃথিবীতে বাস করত এবং আধুনিক মানুষের জিনে তাদের কিছু উপাদান এখনো রয়ে গেছে।
ডেনিসোভানদের প্রথম চিহ্ন পাওয়া যায় ২০১০ সালে, রাশিয়ার সাইবেরিয়ায় ডেনিসোভা নামক এক গুহা থেকে উদ্ধার হওয়া একটি মেয়ের আঙুলের হাড়ের মাধ্যমে। কিন্তু এতদিন তাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে খুব কম তথ্যই পাওয়া গিয়েছিল। ‘ড্রাগন ম্যান’ নামের খুলিটি প্রথম নিশ্চিতভাবে ডেনিসোভানদের একটি পূর্ণাঙ্গ খুলি হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় মানব বিবর্তনের ইতিহাসে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন ঘটেছে।
খুলিটি প্রথম আবিষ্কৃত হয় ১৯৩৩ সালে, চীনের হারবিন শহরের কাছে এক রেলকর্মীর হাতে। কিন্তু তিনি সেই সময় খুলিটি গোপনে একটি কূপে লুকিয়ে রাখেন। অনেক বছর পর, ২০১৮ সালে তার পরিবার সেটি খুঁজে বের করে হেবেই জিও ইউনিভার্সিটিতে দান করে। এরপর বিজ্ঞানীরা খুলিটির পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন এবং এটিকে ‘হোমো লংগি’ বা ‘ড্রাগন ম্যান’ নামে নামকরণ করেন। ‘লংগি’ শব্দটির অর্থ ‘কালো ড্রাগন’, যা খুলিটি যেখান থেকে পাওয়া যায় সেই এলাকার নাম অনুসারে দেওয়া হয়েছে।
গবেষকরা ড্রাগন ম্যানের দাঁতের প্লাক থেকে জিনগত উপাদান বা জিনোম বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত হন যে, তিনি ছিলেন ডেনিসোভান জাতির একজন প্রতিনিধি। খুলিটির গঠনও একে ব্যতিক্রমী করে তোলে—বড় বড় চোখের গর্ত, মোটা ভ্রু এবং ঘন খুলি ড্রাগন ম্যানকে আধুনিক মানুষের তুলনায় অনেক বেশি বলিষ্ঠ ও শক্তিশালী করে তোলে। তাদের মস্তিষ্ক আধুনিক মানুষের থেকে প্রায় ৭ শতাংশ বড় ছিল বলে মনে করা হচ্ছে। খুলির ভিত্তিতে পুনর্গঠিত মুখাবয়বে দেখা যায় চওড়া চোয়াল, বড় নাক ও প্রশস্ত মুখমণ্ডল।
বিশ্বের বৃহত্তম প্রাচীন মানব খুলিগুলোর মধ্যে হারবিনের এই ড্রাগন ম্যান খুলি অন্যতম বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তবে ডেনিসোভানদের বিষয়ে এখনও বহু প্রশ্ন রয়ে গেছে। তারা কি সবসময় এমন বিশাল আকৃতির ছিল, নাকি তাদের মধ্যেও ছিল আকারে বৈচিত্র্য—এমন প্রশ্নের উত্তর এখনও খোঁজার অপেক্ষায়।
গবেষকদের ধারণা, ড্রাগন ম্যানরা উত্তর চীনের ঠান্ডা পরিবেশে শিকারি ও সংগ্রাহক হিসেবে টিকে ছিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, ডেনিসোভানদের হাড় বিভিন্ন উষ্ণ অঞ্চলেও পাওয়া গেছে, যা এই মানবগোষ্ঠীর অভিযোজন ক্ষমতা ও বৈচিত্র্যের প্রমাণ দেয়।
এই আবিষ্কার আমাদের প্রাচীন পূর্বপুরুষদের জীবনধারা, পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর ক্ষমতা এবং মানব বিবর্তনের জটিল ধারা সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। ড্রাগন ম্যানের খুলি আজ শুধু একটি জীবাশ্ম নয়—এটি মানব ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ, সংযোগকারী সেতু।