উজবেকিস্তান জুড়ে গড়ে ওঠা তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) পার্কগুলোর একটি বিস্তৃত নেটওয়ার্ক দেশটির অর্থনৈতিক চেহারা বদলে দিচ্ছে এবং একে একটি আন্তর্জাতিক তথ্যপ্রযুক্তি ও ডিজিটাল পরিষেবা কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলছে। কৌশলগত সরকারি উদ্যোগ, যুবসমাজের অংশগ্রহণ, এবং ব্যবসা-বান্ধব নীতির সমন্বয়ে উজবেকিস্তান দ্রুত বিশ্বমানের আইটি খাত গড়ে তুলছে, যা দেশটির অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল ও সম্ভাবনাময় খাতে পরিণত হয়েছে।
এই রূপান্তরের মূল চালিকা শক্তি হলো “ডিজিটাল উজবেকিস্তান ২০৩০” কৌশল, যার লক্ষ্য একটি শক্তিশালী ডিজিটাল অর্থনীতি গড়ে তোলা। এই কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে ১,০০০ বিদেশি আইটি-সক্ষম (ITES) কোম্পানি আকৃষ্ট করতে, ৩ লাখ নতুন চাকরি সৃষ্টি করতে এবং ৫ বিলিয়ন ডলারের আইটি রপ্তানি অর্জন করতে চায়।
এই উদ্যোগের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে আইটি পার্ক উজবেকিস্তান—যা একটি কর-মুক্ত পরিবেশে আইটি কোম্পানিগুলোর জন্য উদ্ভাবন এবং স্কেলিং সহজতর করে তুলছে। ২০১৯ সালে যাত্রা শুরুর পর থেকে দেশজুড়ে ১৪টি শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে বর্তমানে ২,৪০০-এরও বেশি কোম্পানি নিবন্ধিত, যার মধ্যে ৫৫০টির বেশি বিদেশি। EPAM Systems, G-Core, ITransition, Vention, Dyninno, এবং East Games-এর মতো আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো ইতিমধ্যে উজবেকিস্তানে কার্যক্রম শুরু করেছে, যা দেশটির প্রতিযোগিতামূলক প্রযুক্তি পরিবেশের প্রমাণ।
দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে আইটি পার্ক বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য সুবিধা দিচ্ছে। “ওয়ান-স্টপ-শপ” নামে একটি সেবা চালু রয়েছে, যার মাধ্যমে ব্যবসা নিবন্ধন, পরিচয়পত্র প্রস্তুত, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা এবং অন্যান্য প্রশাসনিক কার্যক্রম এক জায়গায় সম্পন্ন করা যায়। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য তিন বছর মেয়াদি মাল্টিপল-এন্ট্রি “আইটি ভিসা” সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, যার মধ্যে বসবাসের অনুমতি, শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবা অন্তর্ভুক্ত।
“জিরো রিস্ক” প্রোগ্রাম বিদেশি কোম্পানিগুলোর জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে, যারা উজবেকিস্তানে প্রথমবারের মতো ব্যবসা শুরু করতে চায়। এই প্রোগ্রামের আওতায় কোম্পানিগুলো প্রথম ১২ মাস বিনামূল্যে অফিস স্পেস, কর্মীদের বেতনের ১৫% পর্যন্ত ফেরত, এবং প্রশিক্ষণের খরচের ৫০% পর্যন্ত প্রণোদনা পায়।
উজবেকিস্তানের সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে এর তরুণ ও দক্ষ জনগোষ্ঠী। দেশের মোট জনসংখ্যার ৬০% এর কম বয়স ৩০ বছরের নিচে, যারা ইংরেজি (৫০ লক্ষ), জার্মান (৫.৫ লক্ষ), ফরাসি (১ লক্ষ) এবং অন্যান্য ভাষায় দক্ষ। এই বহুভাষিক ও প্রযুক্তি-সচেতন তরুণ সমাজ বিদেশি কোম্পানিগুলোর জন্য একটি আদর্শ কর্মশক্তি সরবরাহ করে।
দেশটির ৬০টিরও বেশি বিশ্ববিদ্যালয়, যেমন তাসখন্দ ইনফরমেশন টেকনোলজিস বিশ্ববিদ্যালয়, ইনহা বিশ্ববিদ্যালয়, এবং অ্যামিটি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রতি বছর ২৯,০০০-এর বেশি শিক্ষার্থীকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সাইবার নিরাপত্তা, ও তথ্যবিজ্ঞানের মতো বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। আইটি পার্কের অধীনে আরও ৩০০টি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে, যেখানে ৪০০টির বেশি কোর্স অফার করা হয়।
উজবেকিস্তান বর্তমানে বিশ্বের মধ্যে কর্মক্ষম জনসংখ্যার অনুপাতে কোর্সেরা শিক্ষার্থীদের সংখ্যায় শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর মধ্যে একটি। সরকার আইটি প্রশিক্ষণ এবং সার্টিফিকেশনের জন্য সম্পূর্ণ অর্থায়ন করে, এবং যেসব শিক্ষার্থী সফলভাবে আইটি-সক্ষম কোম্পানিতে চাকরি পায়, তাদের প্রশিক্ষণের জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে ২,০০০ থেকে ৩,০০০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত ভর্তুকি দেয়।
এই প্রযুক্তিগত উত্থান ইতোমধ্যেই দেশের অর্থনীতিতে বাস্তব প্রভাব ফেলছে। ২০২৪ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে আইটি পার্কের অধিভুক্ত কোম্পানিগুলোতে ৩৬,০০০ জনের বেশি কর্মসংস্থান হয়েছে। উজবেক স্টার্টআপগুলো ১৪৮ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি ভেঞ্চার ক্যাপিটাল অর্জন করেছে এবং দেশটির আইটি রপ্তানি পৌঁছেছে ৭৮টি দেশে।
এই অগ্রগতিকে আরও বেগবান করতে, উজবেকিস্তান আন্তর্জাতিক কনসালটিং সংস্থা EY-এর সঙ্গে যৌথভাবে একটি আন্তর্জাতিক ডিজিটাল সেন্টার তৈরি করছে—”এন্টারপ্রাইজ উজবেকিস্তান”—যা আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর জন্য নিরাপদ, স্থিতিশীল ও উদ্ভাবনবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করবে। এখানে থাকবে বিশেষ আইন-কানুন, তথ্য সুরক্ষা ও মেধাস্বত্ব রক্ষার ব্যবস্থা, এবং বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থায় নির্বিঘ্ন প্রবেশাধিকার।
এই সমস্ত উদ্যোগ একসাথে উজবেকিস্তানকে কেবল একটি আঞ্চলিক নয়, বরং একটি বৈশ্বিক প্রযুক্তি হাব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে। ইউরোপ ও এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থিত এই দেশটি এখন উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য প্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তা ও কোম্পানিগুলোর জন্য এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে।
আরও বিশ্লেষণ, পরিসংখ্যান বা সংশ্লিষ্ট কেস স্টাডি দরকার হলে জানাবেন!