অ আ আবীর আকাশ:
লক্ষ্মীপুর জেলার অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দালাল বাজার নবীন কিশোর উচ্চ বিদ্যালয়। শত বছর আগে জমিদার নবীন কিশোর রায়ের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যালয় শুধু শিক্ষা নয়, সংস্কৃতি, সমাজচেতনা ও নাগরিক নেতৃত্ব তৈরির ক্ষেত্রেও রেখেছে অনন্য ভূমিকা। এই বিদ্যালয়ের শতবর্ষ পূর্তি নিঃসন্দেহে একটি গৌরবোজ্জ্বল মাইলফলক। কিন্তু এই মহতী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যেমন অনেক সাফল্য ছিল, তেমনি কিছু ব্যর্থতা ও অদূরদর্শিতাও প্রশ্ন তুলেছে সচেতন মহলে।
ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্বাক্ষর
দালাল বাজার নবীন কিশোর উচ্চ বিদ্যালয় শুধু একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, এটি একটি সমাজ-সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। প্রাচীন শিক্ষার ধারাবাহিকতা বজায় রেখে এ বিদ্যালয় শতবর্ষ পেরিয়েছে। এখানকার ছাত্ররা বহু ক্ষেত্রেই দেশের জন্য অবদান রেখেছে—প্রশাসন, রাজনীতি, সাহিত্য, সাংবাদিকতা ও মুক্তিযুদ্ধেও রয়েছে বিদ্যালয়ের প্রাক্তনদের অবিস্মরণীয় অবদান।
বিদ্যালয়টির গৌরবোজ্জ্বল অতীত জানাতে গিয়ে জমিদার পরিবারের উদারতা, তৎকালীন সমাজে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি, নারকেল-সুপারির খ্যাতি, শিক্ষার প্রসারে তাদের অবদান সবই ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যা দুর্ভাগ্যজনকভাবে শতবর্ষের সুভেন্যিয়রে অনুপস্থিত।
অনুষ্ঠান আয়োজন: কিছু সাফল্য
শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানটি আয়োজনের ক্ষেত্রে কিছু গঠনমূলক পদক্ষেপ ছিল। উদাহরণস্বরূপ:
বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে মিলনমেলা।
সাংস্কৃতিক পরিবেশনা ও র্যালি।
বিশেষ সুভেন্যিয়র প্রকাশ।
শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের উপস্থিতি।
স্মৃতিচারণমূলক কিছু অনুষঙ্গ।
তবে এই সাফল্যের আড়ালেও ছিল অনেক ব্যর্থতা, বিশৃঙ্খলা, সাংগঠনিক দুর্বলতা ও ভ্রান্ত নীতিনির্ধারণ, যা অনুষ্ঠানটিকে এক অর্থে বিতর্কিত করেছে।
ব্যর্থতার পর্যালোচনা: প্রশ্নগুলোই উত্তর
১. সভাপতির পরিচয় ও প্রশ্ন:
অনুষ্ঠানের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন কে? কেন প্রধান শিক্ষক পদাধিকারবলে এই আসনে ছিলেন না? শিক্ষাঙ্গনের নিজস্ব নিয়মনীতি এবং সম্মানজনক ধারা উপেক্ষা করে কাকে সভাপতির আসনে বসানো হলো তা না জানার কারনে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন।
২. সঞ্চালক কারা ছিলেন?
অনুষ্ঠান পরিচালনায় অভিজ্ঞ ও শুদ্ধ বাংলায় পারদর্শী উপস্থাপক না থাকার কারণে উপস্থাপনায় এলোমেলোতা দেখা গেছে।
৩. পরিচয়পর্ব অনুপস্থিত:
বিদ্যালয়ের সাবেকদের সঙ্গে বর্তমান প্রজন্মের পরিচয়ের জন্য কোনো পর্ব রাখা হয়নি। এতে পুরাতন ও নতুনের সংযোগ গড়ে ওঠেনি।
৪. অনুষ্ঠানের সূচী অদৃশ্য:
যদিও একটি অনুষ্ঠানসূচী প্রণয়ন করা হয়েছিল, কিন্তু তা সবার দৃষ্টিগোচর হয়নি। মঞ্চ, মাঠ বা প্রবেশপথে তা দৃশ্যমান ছিল না।
৫. র্যালির এলোমেলোতা:
র্যালি সংক্ষিপ্ত, অনিয়ন্ত্রিত এবং পরিকল্পনাবিহীন ছিল। পুরনো শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্তি ছিল না বললেই চলে।
৬. শিক্ষকদের অনুপস্থিতি:
বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক অনুষ্ঠানে অংশ নেননি। প্রধান শিক্ষকের বক্তব্যও ছিল বিমর্ষ ও আত্মবিশ্বাসহীন। এতে বোঝা যায়, আন্তঃসম্পর্ক ও মনোযোগের ঘাটতি ছিল প্রবল।
৭. ড্রেস কোডের অনুপস্থিতি:
শতবর্ষ উপলক্ষে কোনো নির্দিষ্ট পোশাক বা ব্যাজের ব্যবহার ছিল না। একতা ও ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে যা খুবই প্রয়োজনীয় ছিল।
৮. মৃত শিক্ষকদের সম্মাননা অনুপস্থিত:
বিদ্যালয়ের প্রয়াত শিক্ষক ও কর্মচারীদের পরিবারের কাউকে কোনোভাবে সম্মাননা জানানো হয়নি, যা ছিল অত্যন্ত সংবেদনশীল এক উপেক্ষা।
৯. অশ্লীল গানের বিতর্ক:
একজন গায়িকার গানের মধ্য দিয়ে অশ্লীলতার ছাপ পড়েছে বলে অনেকেই উল্লেখ করেছেন। সভ্য ও সংস্কৃতিমনা সমাজে এটি অনভিপ্রেত।
১০. হিন্দি গানের অসঙ্গতি:
ভারত-বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে হিন্দি গানের পরিবেশনা সাংস্কৃতিক বোধের অভাবকেই নির্দেশ করে।
১১. মাদকের গন্ধ!
সন্ধ্যায় কোনো একপর্যায়ে মাদকের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ এসেছে। এটি সিকিউরিটির চরম ব্যর্থতা।
১২. আয়োজক কমিটির স্বচ্ছতা নেই:
কে কী দায়িত্বে ছিলেন, তাদের বর্তমান পেশা কী—এ নিয়ে কিছুই স্বচ্ছ নয়। এর ফলে দায় নির্ধারণ অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
১৩. সুভেন্যিয়রের ভুলত্রুটি:
গ্লোসি কাগজে সুন্দর প্রচ্ছদের আড়ালে ছিল বানান ভুল, প্রবন্ধহীনতা, বিশিষ্ট লেখকদের অবদান বর্জন, জন্ম-মৃত্যু তথ্যের গোলমাল। কোনো প্রুফ রিডিং হয়নি বলেই মনে হয়েছে।
১৪. ড্রাই কেক বিতর্ক:
শতবর্ষের মতো আয়োজনে বিকালে স্ন্যাক্স হিসেবে ড্রাই কেক পরিবেশন কিছুটা অপেশাদার সিদ্ধান্ত।
১৫. সিকিউরিটির ভেঙে পড়া:
সন্ধ্যার পর সিকিউরিটি না থাকায় ছাত্রীরা এবং নারী-শিশুরা বিড়ম্বনায় পড়েন। অনেকেই অনুষ্ঠান মাঝপথে ত্যাগ করেন।
১৬. মৌলিক গান অনুপস্থিত:
শিল্পীদের পরিবেশনায় কোনো মৌলিক গান ছিল না। এলোমেলো গিটার ও ভাঙাচোরা সুরে ভরপুর ছিল পরিবেশনা, যা শতবর্ষের মতো অনুষ্ঠানকে হেয় করেছে।
১৭. আর্থিক প্রণোদনার অভাব:
বিদ্যালয়ের বর্তমান বা সাবেক শিক্ষক-কর্মচারীদের কেউই কোনো আর্থিক সম্মাননা পাননি, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ অপূর্ণতা।
১৮. সাংবাদিকদের প্রতি কড়াকড়ি:
অনুষ্ঠানে সংবাদকর্মীদের প্রবেশে কড়াকড়ি ছিল, অথচ মিডিয়া কভারেজ ছাড়া এ ধরনের অনুষ্ঠান বিস্তৃত হয় না।
১৯. তোরণ বা ফলক অনুপস্থিত:
কোনো স্মারক তোরণ, ফলক বা শতবর্ষের স্থায়ী চিহ্ন নির্মাণ করা হয়নি, যা ঐতিহাসিক ব্যর্থতা।
২০. পরিচয়ের সেতুবন্ধ অনুপস্থিত:
পুরনো ও নতুন প্রজন্মের মধ্যে কোনো পরিচয় পর্ব ছিল না। ভবিষ্যতের জন্য স্মৃতির ধারাবাহিকতা গড়ে তোলা হলো না।
সচেতন মহলের হতাশা
এই সব প্রশ্ন ও ব্যর্থতার কারণে সচেতন মহলে এক ধরনের বেদনা ও ক্ষোভ জন্ম নিয়েছে। যারা দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যালয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তারা একে সময়ের অপচয় ও সম্ভাবনার অপচয় বলে উল্লেখ করেছেন।
উপসংহার: পুনর্চিন্তার আহ্বান
দালাল বাজার নবীন কিশোর উচ্চ বিদ্যালয়ের শতবর্ষ উদযাপন একটি স্বর্ণালি সুযোগ ছিল ইতিহাসকে গৌরবান্বিত করার, প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করার। কিন্তু তা ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা, সুপরিকল্পনা ও সংবেদনশীলতার অভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। প্রাক্তন শিক্ষার্থী, শিক্ষকমণ্ডলী, অভিভাবক ও সাংস্কৃতিক সমাজ এখন চায়—শতবর্ষের পরবর্তী সময় যেন হয় নতুন চিন্তা ও প্রতিশ্রুতির সূচনাবিন্দু।
শুধু উৎসব নয়, দায়বদ্ধতার চর্চা হোক আগামীর মূলমন্ত্র।*
লেখক: কবি প্রাবন্ধিক কলামিস্ট ও সাংবাদিক। লোকসাহিত্য গবেষক।