মিউনিখ, ১৩ ফেব্রুয়ারি: ইউক্রেন যুদ্ধের দুই বছর পূর্ণ হতে চলেছে, কিন্তু এখনো এই সংঘাতের কোনো স্থায়ী সমাধান দেখা যাচ্ছে না। ইউরোপ ও আমেরিকার শীর্ষ নেতারা মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে জড়ো হয়েছেন, যেখানে ইউক্রেন যুদ্ধের ভবিষ্যৎ, সামরিক সহায়তা এবং কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।
বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই নিরাপত্তা সম্মেলনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, ন্যাটো মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ, জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস, ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ নেতারা এবং অন্যান্য দেশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা অংশ নিয়েছেন।
শান্তি আলোচনা ও সম্ভাব্য সমাধানের দিকনির্দেশনা
সম্মেলনের মূল আলোচ্য বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কূটনৈতিক সমাধান, রাশিয়ার বিরুদ্ধে নতুন নিষেধাজ্ঞা, ইউক্রেনকে আরও অস্ত্র সরবরাহ, ন্যাটোর সামরিক কৌশল এবং বৈশ্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির ভবিষ্যৎ।
শান্তি আলোচনা কতটা বাস্তবসম্মত?
এ পর্যন্ত কিয়েভ ও মস্কোর মধ্যে সরাসরি শান্তি আলোচনা হয়নি। ২০২২ সালের প্রথম দিকে কিছু আলোচনা হলেও, তা ফলপ্রসূ হয়নি। ইউক্রেন বলছে, তারা কেবল তখনই শান্তি আলোচনায় বসবে, যখন রাশিয়া দখলকৃত ভূখণ্ড থেকে সেনা প্রত্যাহার করবে। অন্যদিকে, রাশিয়া বলছে, পশ্চিমা দেশগুলোর অস্ত্র সহায়তা বন্ধ করা হলে এবং ইউক্রেন নিরপেক্ষ অবস্থানে গেলে তারা আলোচনা করতে রাজি।
জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস বলেন, “শান্তির জন্য আমাদের শক্তিশালী হতে হবে। আমরা ইউক্রেনকে সমর্থন করছি, কিন্তু একই সঙ্গে আলোচনার পথও খোলা রাখতে হবে।”
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন বলেন, “আমরা চাই একটি ন্যায়সঙ্গত ও টেকসই শান্তি। তবে শান্তি কখনোই ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের বিনিময়ে হতে পারে না।”
ইউক্রেনের দাবিগুলো কী?
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি শান্তি আলোচনার জন্য কয়েকটি শর্ত দিয়েছেন:
📌 রাশিয়ার সেনা প্রত্যাহার: ইউক্রেনের দখলকৃত অঞ্চলগুলো থেকে রাশিয়ার সৈন্য প্রত্যাহার করতে হবে।
📌 নিরাপত্তা গ্যারান্টি: ইউক্রেনকে ন্যাটো বা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা চুক্তির অধীনে আনতে হবে।
📌 যুদ্ধাপরাধের বিচার: রাশিয়ার যুদ্ধাপরাধের জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার করতে হবে।
📌 পুনর্গঠন তহবিল: রাশিয়াকে ইউক্রেনের ধ্বংসপ্রাপ্ত অবকাঠামো পুনর্গঠনে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
তবে রাশিয়া এই শর্তগুলোকে একপাক্ষিক বলে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং বলেছে, কিয়েভকে বাস্তবসম্মত অবস্থানে আসতে হবে।
রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এই সম্মেলন একতরফাভাবে ইউক্রেনের পক্ষে সাজানো হয়েছে এবং এতে রাশিয়ার মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না।
রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেন, “আমরা শান্তি চাই, কিন্তু তা আমাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে হলে আমরা মেনে নেব না। পশ্চিমা দেশগুলো যদি সত্যিই শান্তি চায়, তাহলে তাদের অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করতে হবে এবং কিয়েভকে বাস্তবসম্মত আলোচনায় আনতে হবে।”
ন্যাটো ও পশ্চিমা সামরিক সহায়তা
ন্যাটো মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ বলেন, “শান্তি অর্জন করতে হলে আমাদের শক্তিশালী প্রতিরক্ষা গড়ে তুলতে হবে। ইউক্রেনকে আমরা যতদিন প্রয়োজন, ততদিন সহায়তা করব।”
তিনি আরও বলেন, ন্যাটোর সদস্যরা ইউক্রেনকে আরও উন্নত প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম, দূরপাল্লার অস্ত্র এবং প্রশিক্ষণ দেবে।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে ইউক্রেনের জন্য ৬০ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা অনুমোদন করেছে, যা কংগ্রেসে বিতর্কের মুখে পড়েছে।
নতুন নিষেধাজ্ঞার হুমকি
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র সম্মেলনের আলোচনায় রাশিয়ার ওপর আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাব এনেছে। নতুন নিষেধাজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে:
✅ রাশিয়ার তেল ও গ্যাস খাতের ওপর নিষেধাজ্ঞা
✅ সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদনের ওপর নিষেধাজ্ঞা
✅ রুশ নাগরিক ও ব্যবসায়ীদের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা
✅ রাশিয়ার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর কড়াকড়ি
কূটনৈতিক উদ্যোগ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
✅ চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের ভূমিকা: চীন ও তুরস্ক এই সংঘাত সমাধানের জন্য মধ্যস্থতা করতে চাচ্ছে। চীন ইতোমধ্যে একটি শান্তি পরিকল্পনা উত্থাপন করেছে, যেখানে উভয় পক্ষের স্বার্থ রক্ষা করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
✅ জাতিসংঘের প্রচেষ্টা: জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, “আমরা চাই একটি অবিলম্বে অস্ত্রবিরতি এবং কূটনৈতিক সমাধান।”
✅ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কৌশল: যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ রাশিয়ার ওপর চাপ বাড়াতে চায়, কিন্তু তারা সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপে আগ্রহী নয়।
সাধারণ মানুষের অবস্থা ও মানবিক সংকট
ইউক্রেনের সাধারণ জনগণ চরম মানবিক সংকটে পড়েছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী:
🚨 ১০ মিলিয়নের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত
🚨 ৩০ লাখের বেশি শিশু শিক্ষা থেকে বঞ্চিত
🚨 শত শত হাসপাতাল ও স্কুল ধ্বংস
🚨 শীতকালে খাদ্য ও বিদ্যুৎ সংকট চরমে
মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, এই যুদ্ধের অবসান না হলে ইউক্রেনের জনগণের দুর্ভোগ আরও বাড়বে।
শেষ কথা: শান্তি আসবে কবে?
এই সম্মেলন যুদ্ধ শেষ করার কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আনতে পারবে কি না, তা স্পষ্ট নয়।
✅ ইউক্রেন যুদ্ধ অবসানের পথ এখনো কঠিন
✅ পশ্চিমা সামরিক সহায়তা ও নিষেধাজ্ঞা রাশিয়াকে আরও কঠোর অবস্থানে নিতে পারে
✅ রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে মধ্যস্থতা করা ছাড়া টেকসই শান্তি সম্ভব নয়
বিশ্ব এখন অপেক্ষা করছে—এই যুদ্ধ কতদিন চলবে, শান্তি আলোচনা কতটা বাস্তবসম্মত হবে, এবং ভবিষ্যতে ইউক্রেন ও রাশিয়ার ভাগ্য কোন পথে গড়াবে?