লক্ষ্মীপুরে সাহিত্য সংগঠনের প্রশ্নবোধক ভূমিকা !  

সাহিত্য (Literature)-কে বলা হয় মানব ও সমাজ জীবনের দর্পণ বা প্রতিচ্ছবি। মানবজীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে সাহিত্যের বিকাশ ঘটে। সাহিত্যে মানব মনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা এবং মানবজীবনের শাশ্বত ও চিরন্তন অনুভূতি প্রতিফলিত হয়। প্রাচ্যের সাহিত্য সমালোচক শ্রীশচন্দ্র দাস তাঁর ‘সাহিত্য সন্দর্শন’ গ্রন্থের ১৭নং পৃষ্ঠায় সাহিত্যের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলেছেন- ”নিজের কথা, পরের কথা বা বাহ্য-জগতের কথা সাহিত্যিকের মনোবীণায় যে সুরে ঝংকৃত হয়, তাহার শিল্পসংগত প্রকাশই সাহিত্য।

১.

বিনয় এবং দুঃখ দু’টো রেখেই বলতে হচ্ছে লক্ষ্মীপুরে সাহিত্য চর্চার নামে দুই একটা গোষ্ঠী বা সংগঠন যা আছে তারা শুধু সংগঠন সময় কাটাতে আসেন। অনুষ্ঠানের আয়োজন করে চাঁদা কালেকশন করে বসে বসে নিজের,নিজেদের হেকমতি জাহির করেন। আদৌ তারা সাহিত্য চর্চার মূল্য বোঝেন কিনা, সাহিত্যবোদ্ধা কিনা এ নিয়ে কোন মতামত না দিয়ে তাদের আয়োজনে সামিল হলেই বোঝা যাবে কে কতটা পারদর্শী, কে কত লেখেন- পড়েন, কে লেখার মর্ম বোঝেন, কার ভেতরে কত গভীরতা, কে কত গভীরে নামতে পারেন।

এসব প্রশ্নের উত্তর ছাড়াও আরও অনেক কিছু বোঝা যাবে সেখানে গেলেই। সামনের কাতারে বসে তারা গলাবাজি, মাইক বাজি ছাড়া সৃষ্টিশীলতা, সৃজনশীলতা, মননশীলতা, কর্মশীলতা কিবা মেধা, মেধার মূল্যায়ন কোনটাই তাদের মাঝে পরিলক্ষিত হয় না। তারা নিজেদের কবি প্রাবন্ধিক আলোচক বা ইশকুল কলেজের শিক্ষক পরিচয় দিতে যথেষ্ট পছন্দ করেন। কিন্তু তাদের আয়ুষ্কাল শেষের দিকে। এখানে এসে প্রকৃত লেখিয়েদের কাত চিত করে তাদের পাণ্ডিত্য দেখান।

শব্দজোড়া বা লাইন তালি দিলেই যদি কবিতা হতো তাহলে জীবনানন্দ দাশ লিখতেন না সবাই কবি নয়, কেউ কেউ কবি। তাহলে সবাই কবি হতেন। এরা নিজেদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত রেখে সাহিত্য সংগঠনের আয়োজনে আসেন পাণ্ডিত্য জাহির করতে। সংগঠনের মাথাদের কেউ কেউ এদের কাছ থেকে সুবিধা গ্রহণ করেও এদের এখানে এনে তৈলমর্দন করেন। আমি বা আমার মত যারা সৃজনশীলতার প্রশ্নে এক চুলও নড়ি না তাদের কাছে এদের চরিত্র, চেহারা এতটাই স্পষ্ট যে সাহিত্যচর্চার নামে এদের গোঁড়ামি, ন্যাকামি পুরোটাই ফালতুতামি মনে হয়। এরা সংগঠনের আড়ালে সাহিত্যে এক ধরনের টোপ পাতেন।

নবীন প্রতিভা লালন দূরে থাক আরো শক্ত হাতে ইট চাপা দিয়ে রাখেন। এমন এমন সব আজগুবি কথাবার্তা বলেন বেচারা নবীন উদীয়মান লেখিয়ে সাহিত্য চর্চাই ভুলে যান।

২.

অধ্যাপক প্রভাষক শিক্ষক বাংলা বিভাগের এমএ কবি গবেষক গীতিকার সংগঠক ডাক্তার উকিল ইত্যাদি তকমা তাদের লেজে এঁটে সংগঠনে এসে প্রকৃত লিখিয়েদের দূরে বসিয়ে মুখখানা এমন এক ভাবে রাখেন যেন এক একজন ভাষাবিদ, ডক্টর কিবা আহমেদ শরীফ, হুমায়ুন আজাদ বা নিহারঞ্জন ভৌমিকের মত বড় বড় পন্ডিত। আমরা যারা দর্শক সারিতে বসে আছি এরা আমাদের এতটাই বোকা গোবেচারা মনে করে, যে যার মত প্রলাপ আওড়ায়। রবীন্দ্র নজরুলের প্রয়াণ দিবসে কি সব চর্বিত চর্বণ করেন এসব শুনে আমার চান্দি হিট হয়ে যায়। ঘৃণা আসে। কিন্তু ঘোষক ব্যাটা এদের নামের আগে পরে এমন তৈল ঘর্ষণ করেন যাতে বোঝা যায় ‘ব্যাটা শহরে এমন এক কচি কদু যে চিংড়ি দিয়ে রান্নার জন্য ক্রেতার লাইন পড়ে যাবে যাবে অবস্থা।’ এসব যে সস্তা তকমা, আমরা দর্শকরা পছন্দ করি না তা জেনে, বুঝেও অপদার্থ ঘোষক চাঁটনী আওড়ান, যেন আমাদের জিভে জল আসে। ব্যাটা যেন দুই টাকা পায় চাঁটনী বিলানোর বদৌলতে, এমনটাই মনে হয়।

৩.

গত কয়েক বছর ধরে লক্ষ্মীপুরে আরেক অপসংস্কৃতি শুরু হয়েছে যে, সম্মাননা, পদক, বোকাওয়াজ পদক, বর্ষসেরা, মাস সেরা, সাপ্তাসেরা ইত্যাদি নামে পদক দেয়া। এসব পদক দেয়ার পিছনের মূল কারণ হচ্ছে টাকা পয়সা গ্রহণ করা। ঢাকাতেও এসব অপসংস্কৃতি আছে। মফস্বল থেকে বিভিন্ন ব্যক্তিদের চিঠি দিয়ে, ফোন করে ডেকে খরচ বাবদ পাঁচ দশ হাজার টাকা এমনকি ব্যক্তি বিশেষে বিশ ত্রিশ হাজার টাকাও হাতিয়ে পদক ধরিয়ে দেয়। তাদেরই অনুসরণ করে আমাদের লক্ষ্মীপুরে বিভিন্ন সংগঠন এগিয়ে চলছে!

লক্ষ্মীপুরে এ ধরনের অপসংস্কৃতি গত অল্প কয়েক বছর থেকে শুরু হয়েছে। যা আমি বা আমরা যারা প্রকৃত অর্থে লেখালেখির সাথে সংযুক্ত তারা মোটেও পছন্দ করি না। আমরা এ সবকে তৈলমর্দন বলে আখ্যা দিয়ে থাকি। কিছু কিছু চিহ্নিত ব্যক্তি আরো কিছু কিছু চিহ্নিত ব্যক্তির নামধাম বিক্রি করে রাজধানী শহরে ঘুরে বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান থেকে টাকাকড়ি হাতিয়ে তাদের এই শহরে এনে রিক্ত হাতে সম্মাননা তুলে দেন। আহারে তারাও বড় জৌলুস করে সম্মাননা পদকে ভূষিত হয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন। আমি মনে করি তাদের সংস্পর্শে গিয়ে এরা লাইমলাইটে আসে। তাদের উচিত এদের আয়োজনে আসার জন্য টিএডিএ বাবদ মোটা অর্থ নেয়া।

৪.

কে কি কোন বিষয়ে কেন সম্মাননা পেলেন তা খোদ সংগঠনের সভাপতি পর্যন্ত জানতে পারেন কিনা আমার সন্দেহ। কবি সাহিত্যিক গবেষক সাংবাদিক সমাজসেবক সংগঠক এরা সম্মাননা পাবে, পদক পাবে এটা যেমন ভালো কথা তার চেয়ে ভালো কথা হলো এরা কে কোন বিষয়ে, কোন ক্যাটাগরিতে, কিভাবে নমিনেশন পেলেন? নমিনেশন কারা দিলেন? নমিনেশন বোর্ডে অর্থাৎ জুড়ি বোর্ডে কারা কারা থাকলেন? তাদের পরিচয়ই বা কি! কতজনের নাম প্রকাশ হল? কতজন মনোনীত হলেন? কারা চুড়ান্ত করলেন? এর কি কিছু তিল মাত্র লক্ষ্মীপুরের কোন কবি সাহিত্যিক গবেষক সাংবাদিক বা এক্সওয়াইজেড জানতে পারেন?

সংগঠনের সভাপতি জানেন? এ বিষয়ে অনেক সংগঠনের সভাপতির সাথে কথা হয়েছে, উনারা কিছুই জানেন না বলে জানিয়েছেন। তাহলে এসব কার হাতে থাকে? কে এসব সম্পাদন করেন? কত ব্যক্তির কাজ ক’জনে করেন? জানতে চাওয়া অন্যায় নয়। এসব যদি সামনে না আসে, প্রকাশ না হয়, পত্রিকায় না যায়, হিডেন থাকে, তার মানে তো পুরোটাই অন্ধকার, গোলক ধাঁধা। নিশ্চয়ই এর ভিতরে কারচুপি রয়েছে, অর্থ লেনদেন রয়েছে, স্বজনপ্রীতি, তৈলপ্রীতি রয়েছে। এমনও তো হতে পারে এসবের ভেতরে অন্যকোনো (?) প্রীতিও জড়িত। যা কেউ ঘূর্ণাক্ষরেও টের পায় না।

নিকট অতীত ইতিহাসের দিকে তাকালে স্পষ্ট দেখা যায়, লক্ষ্মীপুরে যারা বিভিন্ন সময়ের সম্মাননা পদক বর্ষসেরা মাসসেরা হচ্ছেন তাদের কতজনে কত ভূমিকা রেখেছেন সাহিত্যচর্চায়? কার কতটা প্রকাশনা রয়েছে? কে কি সম্পাদনা করেছেন? গবেষণাধর্মী কার কত বই প্রকাশ হয়েছে! নবীন প্রতিভা বিকশিত করার লক্ষ্যে কার কত অবদান রয়েছে? এসবের কোন উত্তর সম্মাননা পদক বর্ষসেরা মাসসেরাদের কাছ থেকে পাওয়া যাবেনা। তাহলে এরা কিসের ভিত্তিতে কোন যোগ্যতায় এসব পেলেন?

প্রশ্ন নয় জানার আগ্রহ বা আকাঙ্ক্ষা লক্ষ্মীপুর জেলার সচেতন নাগরিকের সাথে প্রকৃত লেখিয়েদেরও। যারা এসব দিয়ে বেড়ান তারাই এর উত্তর দিবেন।

৫.

আরেকটা চরম কষ্টের কথা হচ্ছে সাহিত্যচর্চায় যাদের মৌলিকত্ব রয়েছে, ত্যাগ তিতিক্ষা এমনকি বিভিন্নভাবে সংগঠনের উন্নয়নে নিরলস কাজ করেছেন তাদের অনেকে দূরে সরে আছে, কেউ অসুস্থ আবার অনেকেই আজ প্রয়াত। তাদের পাশে কি দাঁড়িয়েছে কেউ সংগঠনের নেতৃত্বে থেকে? প্রয়াতদের  স্মরণে-প্রয়াণে কতটা মনে রাখি বা রেখেছি! তাদের স্বজনদের খোঁজখবর রেখেছি? না, মোটেই না।

তাহলে শুধু রক্ত দেখে জীবিতদের নিয়েই রং তামাশা চলছে এই শহরে? মনে রাখা প্রয়োজন, লক্ষ্মীপুরেই শুধু নয় পৃথিবীর ইতিহাসে যারা প্রকৃত মেধার মূল্যায়ন না করে, তেলবাজি, গলা বাজি, মাইক বাজি, চাটকারিতা আর পদলেহন করেছে তাদের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করেছে সময়। কেউ তাদের ক্ষমা করেনি।

এর থেকে পরিত্রাণ পাবো কবে বা উত্তরণের উপায় কি প্রকৃত লিখিয়েদের বা আমাদের! সবশেষে শুভবুদ্ধির উদয় হবে বলে আশা রাখি।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

বিষয়: * লক্ষ্মীপুর * সাহিত্য
লাইভ রেডিও
সর্বশেষ সংবাদ