মাদারীপুর সদর উপজেলায় প্রতিপক্ষের হামলায় আপন দুই ভাইসহ তিনজন নিহত হয়েছেন। শনিবার (৮ মার্চ) সকাল ১১টার দিকে উপজেলার খোয়াজপুর ইউনিয়নের খোয়াজপুর এলাকার ৬ নং ওয়ার্ডে এই ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ ও সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। বিশেষ করে মসজিদের মধ্যে হত্যার ঘটনা নিয়ে তোলপাড় চলছে ওই এলাকায়।
আজ ঘটনাস্থলে গেছেন এমন সাংবাদিকরা জানিয়েছেন পুরো এলাকা পুরুষ শূন্য হয়ে পড়েছে এবং সেখানে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। কর্তৃপক্ষ সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করেছে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ওই এলাকার দুই বংশের মধ্যকার দীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক বিরোধ, আধিপত্য বিস্তার এবং নানা বিষয়ে পুঞ্জীভূত ক্ষোভের জের ধরেই এই ঘটনা ঘটেছে।
পুলিশ, স্থানীয় ও নিহতের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, মাদারীপুর সদর উপজেলার খোয়াজপুর ইউনিয়নের খোয়াজপুর এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে একই এলাকার কীর্তিনাশা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে আসছেন খোয়াজপুর ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুল সরদার। আরেক পক্ষ একই এলাকার একই বংশের হোসেন সরদার উত্তোলন করে আসছিলেন।
স্থানীয়দের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, শনিবার বেলার এগারটার দিকে তিন ভাইকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে জেলার সদর উপজেলার খোয়াজপুর ইউনিয়নে সরদার বাড়ির সামনের মসজিদে। এরপর রক্তাক্ত মসজিদের ফ্লোরের ছবি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক মাধ্যমে।
নিহতরা হলেন- আপন দুই ভাই আতাউর রহমান সরদার ও সাইফুল ইসলাম সরদার এবং তাদের চাচাতো ভাই পলাশ সরদার। পুলিশ সুপার মোঃ সাইফুজ্জামান জানিয়েছেন, নিহত সাইফুল ইসলাম সেখানকার ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা ছিলেন।
“বাজার ইজারাসহ বিভিন্ন বিষয়ে অনেক দিন ধরেই তার আধিপত্য ছিলো। এ নিয়ে অন্য পক্ষের সাথে বিরোধের জের ধরে শনিবারের ঘটনা ঘটেছে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি। জানা গেছে, ওই এলাকায় ড্রেজার দিয়ে বালু তোলাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মোল্লা বাড়ি ও সরদার বাড়ির মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজ করছিলো।
আওয়ামী লীগ আমলে স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা হওয়ার সুবাধে বাজার ইজারা ও বালুর ব্যবসাসহ বিভিন্ন খাতের নিয়ন্ত্রণ ছিলো সাইফুল সরদারের হাতে।
গত বছর অগাস্টে সরকার পরিবর্তনের পর মোল্লা বাড়ির শাজাহান মোল্লাসহ কয়েকজন এসব খাতের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা করলে দু পক্ষের মধ্যে নতুন করে বিরোধের সূচনা হয়। শাজাহান মোল্লা স্থানীয় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
নিহতদের মা সুফিয়া বেগম যে মামলা করেছেন তাতে শাজাহান মোল্লাকেই প্রধান আসামি করা হয়েছে।
এছাড়া সাইফুল ইসলাম সম্প্রতি দুই বালু ব্যবসায়ীকে মারধর করে দুই পা ভেঙ্গে দিয়েছিলেন বলেও পুলিশ দাবি করেছে।”মূল বিষয়টি আধিপত্য বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। শনিবার দু’পক্ষের মধ্যে কথা কাটাকাটি থেকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বলে আমরা জানতে পেরেছি,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন পুলিশ সুপার।
ঘটনার শুরু নিয়ে বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য পাওয়া গেছে স্থানীয়দের কাছ থেকে।
তাদের কয়েকজন বলেছেন, শনিবার সরদার বাড়ির সামনেই সাইফুল সরদারকে একা পেয়ে প্রতিপক্ষ হামলা শুরু করে। পরে তাকে রক্ষায় তার ভাই আতাউর ও চাচাতো ভাই পলাশ সরদার এগিয়ে গেলে তারাও আক্রমণের শিকার হয়। এক পর্যায়ে বাঁচার জন্য তারা মসজিদে ঢুকে পড়লে সেখানেই তাদের কুপিয়ে হত্যা করে প্রতিপক্ষ।
আবার স্থানীয়দের অন্য কয়েকজন ভিন্ন ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন। তারা জানিয়েছেন, প্রথমে সরদার বাড়ির সামনেই দুই পক্ষের মধ্যে কথা কাটাকাটি হচ্ছিলো। এর এক পর্যায়ে সাইফুলের পক্ষে থাকা অনেকেই শাজাহান মোল্লার পক্ষে চলে যায়। ফলে দুর্বল হয়ে ঘটনাস্থল থেকে পালানোর চেষ্টা করে সাইফুল এবং তার ভাইয়েরা।
এক পর্যায়ে প্রতিপক্ষের হাত থেকে বাঁচতে মসজিদে ঢুকে পড়েন এবং সেখানেই দুজনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। আর গুরুতর আহত হন পলাশ সরদার।
এই হামলার সময় এবং তার পরে তাদের বসতবাড়িতেও হামলা হয়। এসময় ভাংচুর ও লুটপাটের পর অন্তত তিনটি ঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। এতে আরও কয়েকজন আহত হয়।
থানা পুলিশ বলছে, এর আগেও বালু নিয়েই দুই বংশের লোকজনের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে সেখানে। এর জের ধরেই সাইফুলের হাতে মারধরের শিকার হন এক ব্যবসায়ী।
মূলত এর পাল্টা হিসেবেই শনিবার দেশিয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সরদার বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে। তখনই কথা কাটাকাটি শুরু হয় দু’পক্ষের মধ্যে।
এক পর্যায়ে হামলা থেকে বাঁচতে সরদার বাড়ির সামনের মসজিদে ঢুকে পড়েন সাইফুল এবং তার দুই ভাই। মসজিদের ভেতরে তাদের কুপিয়ে হত্যার সময় কয়েকজন এগিয়ে গেলে তাদের ওপরেও হামলা হয়েছে। এতে দুজন আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।
এ ঘটনার পর সাইফুল ও তার ভাইয়ের বসতঘরে লুটপাট ও ভাংচুর করে আগুন ধরিয়ে দিয়ে সটকে পড়ে হামলাকারীরা। হামলার খবর পেয়ে দ্রুতই ঘটনাস্থলে গিয়ে সাইফুল ও আতাউরের মৃতদেহ উদ্ধার করে মাদারীপুর সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠিয়ে দেয় পুলিশ। আর চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেয়ার পথে মারা যান পলাশ সরদার।
আজ ঘটনাস্থলে গিয়েছেন এমন সাংবাদিকরা জানিয়েছেন, গ্রেফতার আতঙ্কে এলাকাটি এখন পুরুষ শূন্য হয়ে পড়েছে এবং যে মসজিদে ঘটনা ঘটেছে সেখানে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। এছাড়া নিহতদের বাড়ির নারীদের কান্নাকাটি করতে দেখেছেন তারা।