কাশ্মীরের উত্তপ্ত সীমান্ত অঞ্চল চুরান্দা। ভারত-নিয়ন্ত্রিত এই পাহাড়ঘেরা গ্রামে সকালটা শুরু হয়েছিল পাখির কূজন আর আখরোট গাছের পাতার মৃদু শব্দে। স্কুলে প্রার্থনার সময় শিক্ষকেরা কেবল প্রার্থনা করছিলেন—এই শান্ত সুর যেন পরিণত না হয় গোলাবারুদের গর্জনে।
কয়েকদিন আগেই সীমান্তবর্তী এক পর্যটনকেন্দ্রে প্রাণঘাতী হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ২৬ জন। ভারত দায় চাপিয়েছে পাকিস্তানের ওপর, যদিও ইসলামাবাদ তা অস্বীকার করেছে। পাল্টা হিসেবে পাকিস্তান দাবি করছে, তাদের কাছে ‘বিশ্বস্ত গোয়েন্দা তথ্য’ আছে যে ভারত একটি সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এই উত্তেজনার মধ্যে সীমান্তের দুই পাশে আতঙ্কের ছায়া। শিশুদের স্বাভাবিক স্কুলযাত্রার আড়ালে অভিভাবকদের চোখে ঘনিয়ে এসেছে উদ্বেগ। চুরান্দা গ্রামের শিক্ষক ফারুক আহমদের কথায়, “আমরা যেন প্রতিদিন বাঁচার জন্য নয়, লুকিয়ে থাকার জন্য দিন শুরু করি।”
কাশ্মীর ইস্যুতে এর আগেও দু’দফা যুদ্ধ করেছে ভারত ও পাকিস্তান। নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর ছোট-বড় বহু সংঘর্ষ ঘটেছে, তাতে প্রাণ হারিয়েছেন শত শত নিরীহ মানুষ। তাই উত্তেজনা বাড়লে স্থানীয়দের মনে একটা ভীতিকর অভ্যস্ততা তৈরি হয়—তারা জানে কী আসতে পারে।
চুরান্দার ২৫ বছর বয়সী বাসিন্দা আবদুল আজিজ জানালেন, “আমাদের ১৫০০ জনের গ্রামে মাত্র ছয়টি বাংকার আছে। দুদিক থেকেই হামলার শঙ্কা। গোলাগুলি শুরু হলে কোথায় গিয়ে লুকাবো?”
সীমান্তের ওপারে পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত চাকোঠি গ্রামের অবস্থাও ভিন্ন নয়। সেখানকার মানুষজন নিজের বাড়ির পাশে পাহাড়ি ঢালে বাংকার তৈরি করছেন। রাওয়ালপিন্ডি থেকে ছুটি কাটাতে আসা ফয়জান আনায়েত জানালেন, “গুলিবর্ষণ শুরু হলে পরিবার নিয়ে সোজা বাংকারে চলে যাই। এটা আমাদের এখনকার রুটিন।”
এই ক্রমবর্ধমান আশঙ্কার প্রেক্ষিতে পাকিস্তান রেড ক্রিসেন্ট কাশ্মীর শাখা জরুরি রসদ ও চিকিৎসাকর্মী প্রস্তুত রেখেছে। গুলজার ফাতিমা জানিয়েছেন, প্রাথমিক চিকিৎসা, খাদ্য, পানি ও অস্থায়ী আশ্রয়সেবার ব্যবস্থা নিয়ে তারা মাঠে নামছেন। প্রায় পাঁচ শতাধিক পরিবারের জন্য তাঁবু, রান্নার সরঞ্জাম, ও স্যানিটেশন কিটসহ ত্রাণশিবির প্রস্তুত করা হয়েছে।
পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের রাজধানী মুজাফফরাবাদে গঠিত হয়েছে ১০০ কোটি রুপির জরুরি তহবিল। সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে দুই মাসের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য ও ওষুধ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। বন্ধ রাখা হয়েছে ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো, কারণ সেগুলো ভারতের লক্ষ্যবস্তু হতে পারে এমন আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সরকারি সূত্রে জানা গেছে, উদ্ধারকারী ও সিভিল ডিফেন্স ইউনিটগুলোকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। মেরামতের জন্য সরানো হচ্ছে সরঞ্জাম। যুদ্ধ যেন এখন আর শুধু সেনাদের বিষয় নয়, এটি রুটি-রুজির, শিক্ষার, জীবনের অনিশ্চয়তার প্রতিদিনের বাস্তবতা।