গাজার চলমান সংকট ও সামরিক অভিযানের প্রেক্ষাপটে যুক্তরাজ্য সরকার একাধিক কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ইসরায়েলের সঙ্গে চলমান মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আলোচনা স্থগিত করা হয়েছে, লন্ডনে নিযুক্ত ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূতকে তলব করা হয়েছে এবং পশ্চিম তীরের সহিংস বসতি স্থাপনকারীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এই ঘোষণা দেন এবং বলেন, “ইসরায়েলের সামরিক তৎপরতা নৈতিকভাবে অযৌক্তিক এবং কৌশলগতভাবে বিপর্যয়কর।”
মানবিক সংকট এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
গত ১১ সপ্তাহে গাজায় খাদ্য, জ্বালানি ও ওষুধের প্রবেশে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল ইসরায়েল। এই অবরোধের ফলে সেখানে এক ভয়াবহ মানবিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। জাতিসংঘ ও অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থা সতর্ক করে বলেছে—দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনা প্রবল, বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে তীব্র অপুষ্টিজনিত মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়েছে।
জাতিসংঘ জানিয়েছে, ইসরায়েল প্রায় ১০০টি ত্রাণবাহী ট্রাক গাজায় প্রবেশের অনুমতি দিলেও তা মোট চাহিদার তুলনায় “সমুদ্রের একফোঁটা” বলেই মনে করছেন তারা। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্যার কেয়ার স্টারমার বলেন, “মানবিক সাহায্য যথাসম্ভব দ্রুত এবং ব্যাপকভাবে প্রবেশ করাতে হবে।”
পার্লামেন্টে উত্তপ্ত আলোচনা
ডেভিড ল্যামি তার বক্তব্যে বলেন, ইসরায়েলি সরকারের এক মন্ত্রী সম্প্রতি গাজা “পরিষ্কারের” ও ফিলিস্তিনিদের “তৃতীয় দেশে স্থানান্তরের” কথা বলেন। তিনি এর কড়া সমালোচনা করে বলেন, “আমরা একে যেমনটি, ঠিক তেমনই বলব—এটি উগ্রবাদ, এটি বিপজ্জনক, এটি ঘৃণিত এবং এটি একদমই অগ্রহণযোগ্য।”
তিনি আরও বলেন, ইসরায়েল ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর “ভয়াবহ” হামলার শিকার হয়েছে এবং যুক্তরাজ্য সর্বদা তাদের আত্মরক্ষার অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে ইসরায়েলের বর্তমান পথ “নির্বিচারে সহিংসতা ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের” দিকে নিয়ে যাচ্ছে, যা বন্ধ করতে হবে।
নিষেধাজ্ঞা ও বাণিজ্য আলোচনা স্থগিত
বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ হিসেবে যুক্তরাজ্য তিনজন ব্যক্তির ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা এবং চারটি প্রতিষ্ঠানের ওপর সম্পদ জব্দ করার ঘোষণা দিয়েছে। পাশাপাশি, ইসরায়েলের সঙ্গে একটি সম্ভাব্য মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আলোচনা “পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত” স্থগিত রাখা হয়েছে।
ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূতকে ডেকে এই বার্তা স্পষ্ট করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, “নেতানিয়াহুর সরকারের পদক্ষেপগুলো এই সিদ্ধান্তকে অপরিহার্য করে তুলেছে।”
সমালোচনা ও পাল্টা প্রতিক্রিয়া
তবে ব্রিটিশ সংসদের বিরোধী দল কনজারভেটিভ পার্টির সদস্য ডেম প্রীতি প্যাটেল এই পদক্ষেপের সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, “এই ধরনের কঠোর শব্দ ব্যবহার বাস্তব সমস্যার সমাধান করবে না এবং এতে হামাস উৎসাহিত হতে পারে, যেটি একটি সন্ত্রাসী সংগঠন।”
ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওরেন মারমোরস্টেইন ল্যামির বক্তব্যকে “অন্যায্য” এবং “অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্বার্থে পরিচালিত” বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, “বহিরাগত চাপ ইসরায়েলকে তার অস্তিত্ব রক্ষার পথ থেকে সরাতে পারবে না।”
ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি নিয়ে আলোচনা
ডেভিড ল্যামি আরও জানান, যুক্তরাজ্য ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে ফ্রান্স এবং সৌদি আরবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আলোচনায় রয়েছে। তবে ব্রিটিশ কূটনীতিকরা এখনই এই স্বীকৃতি দিতে চাইছেন না। তারা চান এটি ভবিষ্যতের একটি বড় শান্তি চুক্তির অংশ হোক, কেবল প্রতীকী প্রতিক্রিয়া হিসেবে নয়।
বর্তমান পদক্ষেপগুলো স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে, ইসরায়েল-গাজা পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য পশ্চিমা মিত্র রাষ্ট্রের মধ্যে উদ্বেগ গভীরতর হয়েছে। ইসরায়েলের প্রতি ঐতিহাসিক সমর্থন থাকা সত্ত্বেও, ইসরায়েলি সরকার যদি মানবিক সংকট নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, তবে ভবিষ্যতে আরও কঠোর আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া দেখা যেতে পারে।