কাশ্মীরের পেহেলগামে গত ২২ এপ্রিলের সন্ত্রাসী হামলার পর দক্ষিণ এশিয়ার দুই পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র—ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে রাজনৈতিক ও সামরিক উত্তেজনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে। পর্যটকবাহী একটি গাড়িবহরে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার ঘটনার পর ভারতের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, এ হামলার পেছনে পাকিস্তানের মদদ রয়েছে এবং হামলাকারীদের মধ্যে অন্তত দুজন পাকিস্তানি নাগরিক। পাকিস্তান অবশ্য এই অভিযোগ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সীমান্ত অঞ্চলে বিশেষ করে কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখা (এলওসি) বরাবর টানা পাঁচ রাত ধরে ভারত ও পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে, যা নতুন করে সামরিক সংঘাতের আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলেছে। এরই মধ্যে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী দাবি করেছে, ভারতের একটি নজরদারি ড্রোন বা কোয়াডকপ্টার তাদের ভিম্বার জেলার মানাওয়ার সেক্টরে আকাশসীমা লঙ্ঘন করে প্রবেশ করে এবং সেটিকে গুলি করে ভূপাতিত করা হয়। পাকিস্তানি নিরাপত্তা কর্মকর্তারা বলছেন, এতে ভারতের গুপ্তচরচেষ্টা ভেস্তে গেছে এবং তারা যেকোনো আগ্রাসনের জবাব দিতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত।
এদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই পরিস্থিতি নিয়ে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করেছেন, যাতে উপস্থিত ছিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল ও তিন বাহিনীর প্রধানরা। বৈঠকে মোদি জানান, সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি তাঁর পূর্ণ আস্থা রয়েছে এবং প্রতিক্রিয়া জানানোর সময়, পদ্ধতি ও লক্ষ্য নির্ধারণে সেনাবাহিনীকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে।
পেহেলগাম হামলার জেরে ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। শুরু হয়েছে ব্যাপক চিরুনি অভিযান। এখন পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার সন্দেহভাজনকে আটক করা হয়েছে এবং বহু বাড়ি ঘরবাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে। পাশাপাশি নিরাপত্তার কারণে কাশ্মীরের ৮৭টি পর্যটনকেন্দ্রের মধ্যে ৪৮টি আজ থেকে বন্ধ ঘোষণা করেছে স্থানীয় প্রশাসন, যা পর্যটন ও স্থানীয় অর্থনীতির ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে।
এই উত্তপ্ত পরিস্থিতি জাতিসংঘেও প্রতিফলিত হয়েছে। জাতিসংঘের নিউইয়র্ক সদর দপ্তরে ‘ভিকটিমস অব টেরোরিজম অ্যাসোসিয়েশন নেটওয়ার্ক (ভিওটিএএন)’ চালুর অনুষ্ঠানে ভারতের রাষ্ট্রদূত ইয়োজনা প্যাটেল পাকিস্তানকে ‘দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র’ বলে আখ্যা দেন। তিনি পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা মুহাম্মদ আসিফের একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, আসিফ নিজেই স্বীকার করেছেন যে পাকিস্তান সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে প্রশিক্ষণ ও অর্থায়ন দিয়ে থাকে। যদিও পরবর্তীতে আসিফ দাবি করেন, তাঁর বক্তব্য ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে এবং তিনি যুদ্ধের আশঙ্কা নয়, বরং পরিস্থিতির সংকটপূর্ণতা তুলে ধরেছেন।
একইসঙ্গে পানির বিষয়েও দুই দেশের মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়েছে। ভারত একতরফাভাবে ১৯৬০ সালের সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিতের পথে এগোচ্ছে, যা পাকিস্তানের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর প্রতিবাদে পাকিস্তান এই সিদ্ধান্তকে ভিয়েনা কনভেনশন লঙ্ঘন বলে অভিহিত করে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। পাশাপাশি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদেও এ ইস্যু উত্থাপন করবে বলে জানিয়েছে পাকিস্তানের আইনমন্ত্রী।
উল্লেখযোগ্যভাবে, দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতিও চলমান উত্তেজনাকে ঘনীভূত করেছে। ভারত পাকিস্তানের নাগরিকদের ভিসা বাতিল করেছে, বিমান চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে, এমনকি সীমান্তে পারিবারিক বিচ্ছেদ সৃষ্টি হয়েছে, যার একটি মর্মস্পর্শী চিত্র দেখা যায় যখন এক পাকিস্তানি মা তাঁর ভারতীয় পাসপোর্টধারী শিশুকে বিদায় জানিয়ে নিজ দেশে ফিরে যান।
এই পরিস্থিতিতে অনেক আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মনে করছেন, ভারত ও পাকিস্তানের এই উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণে না এলে তা আরও বড় ধরনের সংঘাত বা আঞ্চলিক অস্থিরতার রূপ নিতে পারে। বিশেষত দুটি দেশই পারমাণবিক অস্ত্রধারী হওয়ায় এ ধরনের উত্তেজনার দীর্ঘমেয়াদি কূটনৈতিক ও মানবিক প্রভাব বহুমাত্রিক হতে পারে।