ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং পশ্চিমবঙ্গ সীমান্ত ঘেঁষা এলাকাগুলোতে বহু দশক ধরে বসবাস করা নাগরিকদের এক শ্রেণিকে ‘বিদেশি’ বা ‘অনুপ্রবেশকারী’ আখ্যা দিয়ে তাঁদের বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেওয়ার অভিযোগ বহুবার উঠে এসেছে। ২০২৫ সালেও এ সমস্যার সুরাহা হয়নি, বরং নতুন করে উদ্বেগ বাড়িয়েছে ভারতের জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (NRC) কার্যক্রম ও সীমান্ত বাহিনীর ভূমিকা।
“পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পরিচয় সংকট: ভারতের নাগরিকদের বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার অভিযোগ”
২০১৯ সালে ভারতের আসামে চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত জাতীয় নাগরিক পঞ্জিতে (NRC) ১৯ লাখেরও বেশি মানুষ বাদ পড়ে। এদের অনেকেই জন্মসূত্রে ভারতীয়, কয়েক প্রজন্ম ধরে আসামে বাস করছেন। কিন্তু কাগজপত্রের জটিলতা, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, প্রশাসনিক হয়রানি ও জাতিগত রাজনীতির কারণে তাঁদের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়।
- ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) এবং জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (NRC) প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকে দেশটির বিভিন্ন রাজ্যে বিশেষ করে আসাম, পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরা অঞ্চলে বহু সংখ্যক মানুষ নাগরিকত্ব হারানোর ভয়ে পড়েছেন। এই প্রক্রিয়ায় এমন হাজার হাজার মানুষ রয়েছেন, যাদের জন্ম, বাসস্থান, পরিবার—সবকিছু ভারতের মাটিতে হয়েও তাদের নাগরিকতা অস্বীকার করা হচ্ছে।
- এই পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে ভারত সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলো থেকে ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশে “পুশব্যাক” বা জোরপূর্বক ঠেলে দেওয়ার অভিযোগ উঠছে। বিষয়টি কেবল আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের উদাহরণ নয়, একই সঙ্গে একটি চরম মানবিক সংকট।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষের অভিযোগ—এদের অধিকাংশই “বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশকারী”, অথচ বাস্তবতায় এদের অনেকেই কখনো বাংলাদেশের মাটিতে পা-ও রাখেননি। NRC–র প্রয়োগ ভারতের ভেতরে এক ভয়াবহ মানবিক ও রাজনৈতিক সংকট তৈরি করেছে।
বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থানরত বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (BGB) সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের শেষ দিক থেকে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (BSF) বাড়তি তৎপরতা শুরু করেছে—NRC থেকে বাদ পড়া, বা পরিচয়পত্রহীন মানুষদের গোপনে, কখনো জোরপূর্বক, বাংলাদেশ সীমান্তে ঠেলে পাঠানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
জানা গেছে, গত ছয় মাসে অন্তত ৪৫০ জনকে কৌশলে বাংলাদেশে পাঠানোর চেষ্টা করা হয়েছে, যাদের অধিকাংশই বলছেন, তাঁরা কখনোই বাংলাদেশি ছিলেন না।
মালতী বালা দাস, ৬২ বছরের এক বৃদ্ধা, যিনি ত্রিপুরার গোমতী জেলার বাসিন্দা ছিলেন। তাঁকে এবং তার নাতিকে “বাংলাদেশি” বলে সীমান্তে পুশব্যাক করা হয়। তিনি বলেন:
“আমার জন্ম এই দেশে, বাবারও জন্ম এইখানেই। এখন কী করে আমি বাংলাদেশি হয়ে গেলাম?”
বাংলাদেশের উদ্বেগ ও প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশ সরকার বারবার ভারতের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে, যেন তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট বা নাগরিকত্ব প্রক্রিয়ার ফল বাংলাদেশকে ভোগ করতে না হয়। বিদেশ মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র বলেন, “আমরা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী, কিন্তু আমাদের সীমান্তে বিদেশিদের ঠেলে দেওয়া হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না।”
মোহাম্মদ ফারুক, আসামের বরপেটা জেলার বাসিন্দা, জীবনের ৪৫ বছর সেখানেই ছিলেন। এখন পরিচয়পত্র না থাকার কারণে তাঁকে “বেআইনি অনুপ্রবেশকারী” তকমা দিয়ে বিএসএফ বাংলাদেশ সীমান্তে ঠেলে দিয়েছে।
এ ধরনের কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন এবং চুক্তির সম্পূর্ণ লঙ্ঘন। ১৯৫১ সালের Refugee Convention, এবং ১৯৬৭ সালের Protocol, যেগুলো মানবাধিকার রক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে প্রত্যেক রাষ্ট্রের দায়িত্ব নির্ধারণ করে দেয়, ভারত সরকার সেগুলোকে কার্যত উপেক্ষা করছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সীমান্তে কাউকে জোরপূর্বক পুশব্যাক করা “refoulement”–এর শামিল, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ।
বাংলাদেশও ২০২০ সালের পর জাতিসংঘে একাধিকবার এই সমস্যা তুলে ধরেছে। কিন্তু ভারতের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ হিসেবে দেখানোর কৌশলে বিষয়টি আন্তর্জাতিক মনোযোগ থেকে আড়ালে রয়ে গেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, NRC ও বিদেশি তকমার নেপথ্যে রয়েছে জাতীয়তাবাদী ভোট ব্যাংক–এর রাজনীতি। ভারতের শাসক দল বিজেপি তার ঘরোয়া সমর্থন টিকিয়ে রাখতে অভিবাসী বিরোধী মনোভাব উসকে দেয়।
আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা—এসব রাজ্যে NRC-র মাধ্যমে মুসলমান, দলিত ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়কে কোণঠাসা করার চেষ্টা স্পষ্ট।
বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের ইস্যু তুলে ধরে স্থানীয় জনগণের ক্ষোভ ও দারিদ্র্যের দায় চাপানো হচ্ছে কথিত “বাংলাদেশিদের” ওপর। ফলে রাজনৈতিকভাবে সুবিধা নিচ্ছে একশ্রেণির নেতা ও প্রশাসনিক কাঠামো।
সীমান্তে বসবাসরত মানুষের জন্য বিষয়টি এক দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। অনেকে বলছেন, রাতে ঘুমাতে পারেন না—কখন যে “বিদেশি” তকমা দিয়ে পুশব্যাক করা হবে, সেই আতঙ্কে দিন কাটছে।
বিশেষ করে মহিলা, শিশু ও বৃদ্ধদের অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়। তাদের অনেকেই এখন “দেশহীন” হয়ে পড়েছে—না আছে নাগরিকত্ব, না আছে অধিকার, না আছে নিরাপত্তা।
এই বিষয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থা Amnesty International বলেছে:
“ভারত সরকার নাগরিকত্ব ও পরিচয়ের নামে যেভাবে লাখ লাখ মানুষকে নাগরিকত্বহীন করে তুলছে, তা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।”
নাগরিকত্ব প্রশ্নে এই ধরণের নিষ্ঠুরতা ও অব্যবস্থাপনা কেবল প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করছে না, এটি মানবতার বিরুদ্ধে এক বড় ধরনের অপরাধ। এখন সময় এসেছে দক্ষিণ এশিয়ায় নাগরিক অধিকার নিয়ে সম্মিলিতভাবে ভাবার এবং কোনো মানুষকেই 'নাগরিকত্বহীন' করে দেওয়ার মত ভয়াবহ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর।
বাংলাদেশ সরকার শুরুতে নীরব থাকলেও বর্তমানে বিষয়টি নিয়ে সরব। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়:
“বাংলাদেশ ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে মন্তব্য করে না। তবে কোনো বাংলাদেশি নয় এমন কাউকে জোরপূর্বক সীমান্তে পাঠানোর প্রচেষ্টা মেনে নেওয়া হবে না।”
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (BGB) সীমান্তে নজরদারি বাড়িয়েছে, এবং ভারতীয়দের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে।
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে যে পরিস্থিতি গড়ে উঠছে, তা শুধু কূটনৈতিক নয়—একটি মানবিক বিপর্যয়। জন্মভূমিতে থেকেও কেউ যদি পরিচয়হীন হয়, রাষ্ট্র যদি নাগরিককে অস্বীকার করে—তবে তা জাতিসংঘ ঘোষিত মানবাধিকারের মৌলিক নীতির বিরোধিতা করে।
পরিচয়, নাগরিকত্ব, ভোটার তালিকা—এসবই রাষ্ট্রের কাঠামো। কিন্তু মানুষের অধিকার, সম্মান ও নিরাপত্তা কোনো কাগজপত্রের উপর নির্ভর করে না।
বাংলাদেশ সরকার, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর উচিত—এই অনৈতিক ও অমানবিক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে সুনির্দিষ্ট অবস্থান গ্রহণ করা।