ভারতে, সমাজের এই অংশটি প্রথাগতভাবে সর্বনিম্ন শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং তাদেরকে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। কাস্ট সিস্টেমে তারা শুদ্র বা নিম্ন বর্ণের বাইরে, অর্থাৎ সবার থেকে আলাদা হিসেবে গণ্য হতো। তাদেরকে বিভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক, এবং সাংস্কৃতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হত।
১. দলিতদের ইতিহাস এবং কাস্ট সিস্টেম:
ভারতীয় সমাজে কাস্ট সিস্টেম প্রাচীন কাল থেকেই বিদ্যমান, এবং এটি মূলত চারটি প্রধান শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছিল—ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, ও শূদ্র। এই শ্রেণীবিভাজন এমনভাবে তৈরি হয়েছিল যাতে শূদ্র এবং তারও নিচের গোষ্ঠীগুলিকে সর্বদা সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে নিচু অবস্থানে রাখা হতো। তাদের “অচ্ছুত” বা “অপবিত্র” হিসেবে গণ্য করা হতো, অর্থাৎ তাদের স্পর্শ করা বা তাদের কাছাকাছি যাওয়া অপবিত্র হিসেবে বিবেচিত হত।
এই ব্যবস্থা তাদের জীবনের প্রতিটি দিককে প্রভাবিত করেছিল—খাবার, বাসস্থান, শিক্ষার সুযোগ, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, এমনকি বিবাহিত জীবনেও। তাঁদের কেবল নিম্ন শ্রেণির কাজ করতে দেওয়া হত, যেমন ময়লা পরিষ্কার করা, চামড়া খসানো, মৃতদেহ সৎকার করা ইত্যাদি।
২. ড. বি. আর. আম্বেদকরের ভূমিকা:
ড. বি. আর. আম্বেদকর ছিলেন একাধিক ক্ষেত্রের একজন সমাজ সংস্কারক এবং দলিতদের প্রধান প্রতিনিধি। তিনি ১৯৫০ সালে ভারতের সংবিধান রচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং তার অন্যতম লক্ষ্য ছিল দলিতদের জন্য সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা। আম্বেদকর জানতেন যে, কেবল আইনি পদক্ষেপের মাধ্যমে এই বৈষম্য দূর করা সম্ভব নয়, তাই তিনি মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে কাজ করেছিলেন।
তিনি একসময় হিন্দু ধর্মের প্রতি বিরাগী হয়ে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন, কারণ হিন্দু ধর্মে দলিতদের প্রতি যে বৈষম্য বিদ্যমান ছিল, সেটি তার কাছে অগ্রহণযোগ্য মনে হয়েছিল। আম্বেদকরের এই সিদ্ধান্ত দলিত সমাজের জন্য এক নতুন দিশা খুলে দেয়।
৩. দলিত সাহিত্য এবং সংস্কৃতি:
দলিত সাহিত্য বা “দলিত সাহিত্য আন্দোলন” একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক আন্দোলন। এর মাধ্যমে দলিত লেখকরা তাদের জীবনের সংগ্রাম, হতাশা, অসম্মান এবং প্রতিবাদকে সাহিত্যিক রূপে প্রকাশ করেছেন। তারা যে বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে সাহিত্য রচনা করেছেন, তা ভারতের সমাজের একটি অন্ধকার দিক উন্মোচন করেছে। দলিত সাহিত্য দলিতদের গৌরবময় ইতিহাস এবং তাদের সংগ্রামের কাহিনী বলে।
মনোরঞ্জন ব্যাপারী, শিরীষ কুমার, নীরাজ লোধি, কানাইলাল সাও, ও আরও অনেক দলিত লেখক তাদের লেখায় সমাজের অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। এই সাহিত্য আন্দোলন সামাজিক পরিবর্তনের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
৪. বর্তমান পরিস্থিতি:
ভারতীয় সংবিধান ১৯৫০ সালে কার্যকর হওয়ার পর, দলিতদের বিরুদ্ধে বৈষম্য নিষিদ্ধ হয়েছে এবং তাদের জন্য সংরক্ষিত আসন রাখা হয়েছে। তবুও, সমাজের কিছু অংশে বৈষম্য এখনও বিদ্যমান। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকাগুলোতে দলিতদের সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এবং শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। যদিও ভারত সরকার দলিতদের জন্য বিভিন্ন স্কিম এবং সুযোগ তৈরি করেছে, কিন্তু বাস্তবে তা কতটা কার্যকর, সে প্রশ্ন উঠেছে।
এছাড়া, কিছু জায়গায় দলিতদের প্রতি হিংসাত্মক আচরণ ও অবমাননা চলতেই থাকে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দলিতদের প্রতি সমর্থন থাকলেও, এটি কখনো কখনো ভোটব্যাংক রাজনীতির অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যা তাদের প্রকৃত উন্নতির জন্য উপকারী নয়।
৫. দলিতদের ভবিষ্যত:
ভারতের সংবিধান তাদের অধিকার ও মর্যাদা সুরক্ষিত করেছে, তবে সামাজিক বাস্তবতায় অনেক বাধা রয়েছে। অনেক দলিত পরিবার এখনও ভূমিহীন, শিক্ষা থেকে বঞ্চিত এবং স্বাস্থ্যসেবা থেকে দূরে রয়েছে। বিশেষ করে, অনেক জায়গায় এখনও স্কুলে বা হাসপাতালে দলিতদের গ্রহণ করা হয় না, তাদের আলাদা রাখা হয়, তাদের উপরে শারীরিক আক্রমণ করা হয়।
এছাড়া, ভারতে রাজনৈতিক সচেতনতা এবং অধিকার বিষয়ে শিক্ষার প্রসারে কিছু অগ্রগতি হয়েছে, কিন্তু এর পরিমাণ খুবই কম। তাই, দলিতদের জন্য সত্যিকারের উন্নয়ন, সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা এবং মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে হলে শিক্ষা, সাংস্কৃতিক সচেতনতা, ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
দলিতদের অধিকার রক্ষায় আরও পদক্ষেপ:
১. শিক্ষার উন্নয়ন: দলিত শিশুদের মধ্যে শিক্ষা ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকার এবং সমাজকে শিক্ষার ক্ষেত্রে আরো জোর দেওয়া প্রয়োজন।
২. রাজনৈতিক অংশগ্রহণ: দলিতদের রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়ানো, তাদের ভোটাধিকারের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা, এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বে অংশগ্রহণ করার সুযোগ সৃষ্টি করা।
৩. সামাজিক সচেতনতা: সমাজের মধ্যে দলিতদের প্রতি বিদ্যমান পক্ষপাতিত্ব, বৈষম্য এবং হিংসা সম্পর্কে আরও আলোচনা ও শিক্ষা আয়োজন করা।
৪. অর্থনৈতিক উন্নয়ন: দলিতদের জন্য চাকরির সুযোগ, প্রশিক্ষণ, এবং উদ্যোক্তা উদ্যোগগুলোকে আরও উৎসাহিত করা।
উপসংহার:
দলিতদের অধিকার এবং মর্যাদার জন্য লড়াই আজও চলমান। যেহেতু ভারতীয় সমাজের বৈষম্য অনেক গভীর এবং ঐতিহাসিকভাবে প্রোথিত, তাই এর পরিবর্তন সাধন করতে সময় ও ব্যাপক সংগ্রাম প্রয়োজন। তবে, শিক্ষা, সচেতনতা এবং প্রতিবাদ আন্দোলনগুলো কার্যকর হলে এই বৈষম্যকে ধীরে ধীরে দূর করা সম্ভব।