মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরেই রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে, বিশেষ করে যখন এটি প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বর্তমান ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সম্পর্কের প্রসঙ্গ আসে।
সম্প্রতি, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সাময়িকভাবে ইউক্রেনের সামরিক সহায়তা বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এটি ওভাল অফিসে প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সঙ্গে একটি উত্তপ্ত বৈঠকের পর আসে। ট্রাম্প মনে করছেন, ইউক্রেনকে শান্তি আলোচনায় আনতে হলে সামরিক সহায়তা বন্ধ রাখা হতে পারে একটি কার্যকর কৌশল। কিন্তু কিয়েভ এই সিদ্ধান্তকে বিরূপভাবে দেখছে এবং জেলেনস্কি বলেছেন, তিনি “সবকিছু ঠিক করতে” প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
২০১৯ সালের বিতর্কিত ফোনালাপ ও অভিশংসন
এর আগে ২০১৯ সালে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির মধ্যে একটি ফোনালাপ বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তোলে। অভিযোগ ওঠে যে ট্রাম্প, ইউক্রেনে তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরুর জন্য চাপ দিয়েছিলেন এবং এর বিনিময়ে সামরিক সহায়তা স্থগিত রাখার হুমকি দিয়েছিলেন। এই ঘটনাই ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মার্কিন কংগ্রেসে অভিশংসন প্রক্রিয়া শুরু করার মূল কারণ হয়ে ওঠে। যদিও পরে তিনি সেনেটে খালাস পান, এই ঘটনা ইউক্রেন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে জটিল করে তোলে।
বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব
ট্রাম্পের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা প্রস্তুতিকে দুর্বল করতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে, বিশেষ করে যখন ইউক্রেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। একই সঙ্গে, ইউরোপীয় দেশগুলো ইউক্রেনের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিলেও, ট্রাম্প প্রশাসনের নীতির কারণে পশ্চিমা মিত্রদের মধ্যেও অস্থিরতা তৈরি হতে পারে।
ইউক্রেনে বর্তমানে সংঘর্ষের পরিস্থিতি আরও তীব্র হয়েছে। রাশিয়া সম্প্রতি ইউক্রেনের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়েছে, যা দেশের জ্বালানি ও গ্যাস অবকাঠামোতে বড় ধরনের ক্ষতি করেছে। এই হামলায় অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন।
এই পরিস্থিতিতে, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের সাথে গোয়েন্দা তথ্য ভাগাভাগি স্থগিত করেছে এবং সামরিক সহায়তা বন্ধ করেছে, প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে আলোচনার টেবিলে আনতে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়ার বিরুদ্ধে বড় ব্যাংকিং নিষেধাজ্ঞা ও শুল্ক আরোপের বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়েছেন যদি তারা যুদ্ধবিরতি ও শান্তি চুক্তি নিয়ে আলোচনা না করে।
এদিকে, ইউক্রেনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন যে উত্তর কোরিয়ার সৈন্যরা কুর্স্ক ওবলাস্টে ভূমি দখল করেছে, যা যুদ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। এই পরিস্থিতিতে, ইউরোপীয় নেতারা সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা করছেন, যা ক্রেমলিন সতর্ক দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছে।
ইউক্রেনে চলমান সংঘর্ষের মধ্যে সাম্প্রতিক ঘটনাবলী নিম্নরূপ:
যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ বন্ধ করেছে, যা রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে ইউক্রেনের হামলার সক্ষমতায় প্রভাব ফেলতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাম্প্রতিক সম্মেলনে সদস্য রাষ্ট্রগুলো ইউক্রেনের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছে, তবে হাঙ্গেরি এই বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছে। কিছু প্রতিবেদনে ইউক্রেন যুদ্ধে চীনের সরাসরি সম্পৃক্ততার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। ইউক্রেনকে রক্ষায় একটি জোট গঠনের প্রচেষ্টা চলছে, যা ইউরোপের ঐক্য বা যুদ্ধের নতুন মোড় হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। যুদ্ধ বন্ধের প্রচেষ্টা চলমান থাকা সত্ত্বেও রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত অব্যাহত রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের সাম্প্রতিক নীতিগুলো পশ্চিমা মিত্রদের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধ ও ন্যাটোর সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিবর্তন পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের নীতির প্রভাব:
- ন্যাটোতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা:
ট্রাম্প অতীতেও ন্যাটোর প্রতিরক্ষা ব্যয় নিয়ে ইউরোপীয় দেশগুলোকে দায়ী করেছেন। তিনি আবারও ন্যাটো নিয়ে কঠোর অবস্থান নিলে জোটের স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়তে পারে। - ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা স্থগিত:
সম্প্রতি ট্রাম্প প্রশাসন ইউক্রেনের সামরিক ও গোয়েন্দা সহায়তা স্থগিত করেছে, যা দেশটির প্রতিরক্ষা সক্ষমতাকে দুর্বল করতে পারে এবং পশ্চিমা মিত্রদের বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলতে পারে। - ইউরোপীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন:
ট্রাম্প যদি ইউরোপে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি কমানোর সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে রাশিয়ার প্রভাব বাড়তে পারে এবং ইউরোপের দেশগুলো নিজেদের নিরাপত্তার বিষয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য হতে পারে।
পশ্চিমা বিশ্বে উদ্বেগ:
- ইউরোপীয় ইউনিয়ন: ইউরোপের নেতারা এরই মধ্যে ইউক্রেনের জন্য আলাদা প্রতিরক্ষা তহবিল গঠনের আলোচনা শুরু করেছেন।
- ফ্রান্স ও জার্মানি: ট্রাম্প প্রশাসনের নীতির ফলে ফ্রান্স ও জার্মানি ইউরোপীয় নিরাপত্তার জন্য স্বাধীন উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানাতে পারে।
- যুক্তরাজ্য: ট্রাম্পের অবস্থান যুক্তরাজ্যের জন্যও কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে, কারণ তারা ঐতিহ্যগতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র।
ট্রাম্প প্রশাসনের নীতিগুলো যদি পশ্চিমা বিশ্বকে বিভক্ত করে, তাহলে রাশিয়া ও চীন এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তাদের ভূরাজনৈতিক প্রভাব আরও বাড়াতে পারে। ফলে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি নতুন ভারসাম্যহীনতা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।