জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে ইসরায়েলকে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে যৌন এবং লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা
ব্যবহারের অভিযোগ করেছেন, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের লঙ্ঘন এবং যুদ্ধাপরাধের একটি গুরুতর দিক হিসেবে উঠে এসেছে। এই রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে যে, ইসরায়েলি বাহিনী ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতা, ধর্ষণ এবং প্রকাশ্যে নগ্ন করার মত অত্যাচার চালাচ্ছে, যা একটি পরিকল্পিত প্রচেষ্টার অংশ। এক্ষেত্রে এটি শুধু একক অপরাধের ফলাফল নয়, বরং এটি ইসরায়েলী বাহিনীর নিয়মিত কর্মসূচির অংশ এবং এটি ফিলিস্তিনিদের আতঙ্কিত করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে।
এছাড়া, জাতিসংঘের তদন্ত কমিটি দাবি করেছে যে গাজার বিভিন্ন মাতৃস্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং প্রজনন সেবা হাসপাতাল ধ্বংস করা হয়েছে, যা ফিলিস্তিনিদের জন্মগ্রহণ প্রতিরোধের লক্ষ্যে পরিকল্পিত কার্যক্রম হতে পারে। এই ধরনের ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম জাতিসংঘের গণহত্যার আইনে একটি খারাপ দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
এই রিপোর্টের প্রতিবেদন একদিকে যেমন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে, তেমনি এটি ইসরায়েল এবং তার মিত্রদের মধ্যে বিতর্কও সৃষ্টি করেছে। ইসরায়েল সরকার এই প্রতিবেদনকে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং দাবি করেছে যে এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন।
১. যৌন এবং লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার অভিযোগ
জাতিসংঘের স্বাধীন আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন ২০২১ সালে গঠিত হয়েছিল, যার লক্ষ্য ছিল ফিলিস্তিনের অধিকৃত অঞ্চলগুলিতে মানবাধিকার লঙ্ঘন অনুসন্ধান করা। এই কমিশন তার নতুন প্রতিবেদনটির মাধ্যমে বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর দাবি করেছে। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, ইসরায়েলি বাহিনী ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতা, ধর্ষণ, যৌন হেনস্থা, প্রকাশ্যে নগ্ন করা এবং অন্যান্য যৌন আক্রমণ করছে। এটি এমন একটি পদ্ধতি হিসেবে পরিগণিত হয়েছে, যা সন্ত্রাসী উদ্দেশ্যে ব্যবহার হচ্ছে এবং যা মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে অভিহিত।
এই অভিযোগের মধ্যে সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, একে কোনো একক ব্যক্তির অপরাধ হিসেবে না দেখে ইসরায়েলি বাহিনীর একটি সংগঠিত প্রচেষ্টা হিসেবে দেখানো হয়েছে। জাতিসংঘের কমিশনের চেয়ারপার্সন নাভি পিল্লাই জানান যে, এই সহিংসতার উদ্দেশ্য ফিলিস্তিনিদের আতঙ্কিত করা এবং তাদের আত্মনির্ধারণের অধিকারকে ক্ষুণ্ন করা।
কমিশনের অন্যান্য সদস্যদের মতে, ইসরায়েলি বাহিনী কেবল নির্দিষ্ট ফিলিস্তিনিদের উপরই এই সহিংসতা পরিচালনা করছে না, বরং এটি একটি প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতি হিসেবে চলমান। এর মধ্যে ধর্ষণ, যৌন হেনস্থা এবং নারী-পুরুষের ওপর নিপীড়ন উল্লেখযোগ্য।
২. গর্ভধারণ এবং প্রজনন স্বাস্থ্য সেবার ধ্বংস
জাতিসংঘের তদন্ত রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে যে, গাজার বিভিন্ন মাতৃস্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রগুলো ইসরায়েলি বাহিনী দ্বারা ধ্বংস করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বিশেষভাবে গাজার আল-বাসমা আইভিএফ সেন্টারের ওপর আক্রমণটির উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে প্রায় ৪,০০০ ভ্রূণ এবং ১,০০০ শুক্রাণু ধ্বংস করা হয়েছিল।
এটি ইসরায়েলি বাহিনীর একটি পরিকল্পিত পদক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা ফিলিস্তিনিদের জন্মগ্রহণ বন্ধ করতে এবং তাদের জনসংখ্যার বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে পরিচালিত হতে পারে। এই ধরনের কর্মকাণ্ড জাতিসংঘের গণহত্যার আইনের আওতায় পড়ে, যেখানে জাতি বা গোষ্ঠীকে শারীরিকভাবে ধ্বংস করার বা জন্মগ্রহণ প্রতিরোধের উদ্যোগকে গণহত্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
প্রতিবেদনটি দাবি করে যে, আল-বাসমা আইভিএফ সেন্টারের আক্রমণটি একটি বড় ধরনের যুদ্ধে আক্রমণের লক্ষ্যে, যা প্রজনন সেবা সমাপ্ত করতে এবং ফিলিস্তিনিদের জন্মদানের ক্ষমতাকে খর্ব করতে পরিচালিত হয়েছিল।
৩. ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া
ইসরায়েল এই রিপোর্টের অভিযোগগুলো সঠিক নয় এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তৈরি বলে দাবি করেছে। প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহু প্রতিবেদনটিকে “বেইমানি” এবং “অযথা অভিযোগকারী” বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন যে জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের সদস্যরা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নির্লজ্জভাবে মিথ্যা অভিযোগ তুলছে এবং এটি একটি “এন্টি-সেমিটিক” কাঠামো।
ইসরায়েলি সরকার একাধিকবার বলেছে যে তারা অত্যন্ত কঠোরভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং তাদের বাহিনী কোনো ধরনের অপরাধমূলক কাজের জন্য কখনোই অনুমোদন দেয় না। তারা দাবি করেছে যে, জাতিসংঘের রিপোর্টের মধ্যে কোনো নির্ভরযোগ্য প্রমাণ নেই এবং এটি একপেশে তথ্যের উপর ভিত্তি করে তৈরি।
৪. আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
এই জাতিসংঘ রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক মহলে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। কিছু দেশ ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে যুদ্ধাপরাধ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে নিন্দা করেছে, আবার কিছু দেশ ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে।
ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো এই রিপোর্টকে স্বাগত জানিয়েছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ইসরায়েলকে দায়ী করার জন্য আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানিয়েছে। তারা বলেছে, এই ধরনের কর্মকাণ্ডের ফলে ফিলিস্তিনিরা দীর্ঘ সময় ধরে অত্যাচারিত হচ্ছে, এবং এটি আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।
৫. আইনি পদক্ষেপ এবং ভবিষ্যৎ
বর্তমানে এই প্রতিবেদনটির পর আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, তবে এটি আন্তর্জাতিক আদালত বা আইসিসি (ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট) এর সামনে আনার জন্য প্রস্তুতি হতে পারে। এধরনের পদক্ষেপ ইসরায়েল এবং তার মিত্রদের উপর আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি করতে সাহায্য করবে।
এখনকার পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল, এবং এই রিপোর্টের পরবর্তী পর্যালোচনাগুলো আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে যুদ্ধকালীন অপরাধ এবং নাগরিকদের সুরক্ষা নিয়ে আরও তীব্র আলোচনা সৃষ্টি করবে।