আনোয়ার মুরাদ | তারিখ: ৪ জুন ২০২৫ গাজা উপত্যকা—একটা ভূখণ্ড, যার আকাশে প্রতিদিন বোমার শব্দ, মাটিতে রক্ত, এবং ঘুম ভাঙে ধ্বংসস্তূপে। গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর চলমান বিমান ও স্থল হামলায় আরও ৯৭ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। শিশু, নারী, বৃদ্ধ—কেউ বাদ নেই। এর ফলে ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া যুদ্ধের মাত্র ২০ মাসে মোট মৃত্যুর সংখ্যা পেরিয়ে গেছে ৫৪ হাজার।
৫৪ হাজার মৃত্যু সংখ্যার চেয়ে বড় হলো একটি প্রশ্ন: “আর কত মৃত্যু হলে পৃথিবী জাগবে?”
আনোয়ার মুরাদ
একটি জাতির চিৎকার
দৈনন্দিন মৃত্যু সংখ্যা এখন শুধু পরিসংখ্যান নয়—তা হয়ে উঠেছে একটি জ্বলন্ত জাতির কান্না। নিহতদের মধ্যে রয়েছে বহু শিশু, যারা হয়তো স্কুলব্যাগ কাঁধে না তুলে বেঁচে থাকার আশায় আশ্রয়কেন্দ্রে লুকিয়েছিল। এমনকি আশ্রয় কেন্দ্র বা হাসপাতালও নিরাপদ নয়। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গাজার ৮৫ শতাংশ মানুষ ইতোমধ্যেই বাস্তুচ্যুত।
“আমি আমার তিন সন্তানকে হারিয়েছি,” বলেন গাজার খান ইউনুস এলাকার বাসিন্দা এক মা, যিনি নিজেই পায়ের নিচে ধ্বংসস্তুপ থেকে জীবিত বেরিয়ে এসেছেন। “আমরা কিছুই করিনি, শুধু বেঁচে থাকতে চেয়েছিলাম।”
চিকিৎসা ব্যবস্থা ধসে পড়েছে
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মাত্র একটি হাসপাতাল جزئيভাবে চালু আছে। ইসরায়েলি অবরোধ ও হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে অধিকাংশ হাসপাতাল। জ্বালানি নেই, পানি নেই, ওষুধ নেই। চিকিৎসকদের অনেকেই নিহত হয়েছেন, অনেকে কাজ করছেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) জানায়, “গাজা এখন বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক সংকটের অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।”
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া—শব্দ আছে, কাজ নেই
জাতিসংঘ বারবার যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানালেও বাস্তবে তার কোনো ফল দেখা যাচ্ছে না। আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, এবং আরব দেশগুলো মানবিক সহায়তা পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিলেও গাজায় প্রবেশে ইসরায়েলি অনুমতির অভাবে তা ব্যাহত হচ্ছে।
বিশেষ করে দক্ষিণ রাফাহ সীমান্তে ইসরায়েলি অভিযানকে কেন্দ্র করে মানবিক করিডোর বন্ধ থাকায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। খাবার, ওষুধ, পানির সংকট এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে অনেকে বাধ্য হয়ে নোনা পানি পান করছে।
বাচ্চাদের চোখে যুদ্ধ
“আমার ভাইকে মাথায় গুলি করে মেরে ফেলেছে,” বলছিল ৯ বছরের আমিরা। তার চোখে কোনো অশ্রু নেই, কারণ অনেক দিন আগেই সে কান্না করতে ভুলে গেছে।
ইউনিসেফ-এর তথ্যমতে, প্রতি তিন শিশুর একজন যুদ্ধের কারণে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। অনেক শিশু আর কথা বলে না, হাসে না। তাদের শৈশব কবরস্থ হয়েছে বোমার শব্দে।
গাজা এখনো প্রতিরোধে বাঁচে
হয়তো ইসরায়েলের লক্ষ্য ছিল গাজাকে চুপ করিয়ে দেওয়া, কিন্তু গাজার প্রতিরোধ থেমে নেই। ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়ানো মানুষগুলো হাতে তুলে নিচ্ছে নিজেদের গল্প—ছবিতে, লেখায়, কণ্ঠে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে সাধারণ ফিলিস্তিনিরা হয়ে উঠছে তাদের জাতির মুখপাত্র।
একটি প্রশ্ন: বিশ্ব কি শুধু দর্শক?
গাজা আর কোনও সাধারণ যুদ্ধক্ষেত্র নয়—এটি এখন মানবতা ও নৃশংসতার সীমারেখা। প্রশ্ন উঠেছে, বিশ্ব যতদিন নির্বিকার থাকবে, ততদিন কি এই হত্যাযজ্ঞ চলতেই থাকবে?
ইতোমধ্যে ১০ লক্ষাধিক শিশু যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বড় হচ্ছে। এরা কেউ স্কুলে যেতে পারছে না, কারও বাবা নেই, মা নেই, ভবিষ্যৎ নেই।
গাজা এখন শুধু একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চল নয়—এটি হয়ে উঠেছে মানবিক সংকটের প্রতীক। যেখানে প্রতিদিন নতুন গণকবর খোঁড়া হয়, আর বেঁচে থাকা মানুষগুলো পরিণত হচ্ছে ‘চলন্ত লাশে’।