কুয়েতে গত ছয় মাসে প্রায় ৪২,০০০ মানুষকে নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী বলে দাবি করা হচ্ছে। কুয়েতের নতুন শাসক, আমির মিশাল আল-আহমাদ আল-জাবের আল-সাবাহ-এর শাসনে এই কঠোর নীতি কার্যকর হয়েছে। সরকার দাবি করছে, “অবৈধভাবে” কুয়েতি নাগরিকত্ব পাওয়া বিদেশিদের টার্গেট করতেই এই পদক্ষেপ, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক বিরোধী এবং প্রাকৃতিকভাবে নাগরিকত্বপ্রাপ্তদেরও এর আওতায় আনা হচ্ছে।
বিরোধী দমন ও সংসদ বাতিল
৮৪ বছর বয়সী আমির মিশাল ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ক্ষমতায় আসার পর কুয়েত আরও স্বৈরতান্ত্রিক পথে এগোচ্ছে। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, গণতন্ত্রকে ব্যবহার করে কেউ যেন রাষ্ট্রকে ধ্বংস করতে না পারে, এই কারণ দেখিয়ে ২০২৪ সালের মে মাসে তিনি সংসদ স্থগিত করেন এবং সংবিধান পরিবর্তনের ঘোষণা দেন।
এই পদক্ষেপের সমালোচনা করায় অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, এবং পার্লামেন্টের সদস্যদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এই দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল নিন্দা জানিয়েছে।
নাগরিকত্ব বাতিল: ভয়াবহ বাস্তবতা
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে কুয়েত নাগরিকত্ব বাতিলের নতুন নীতি গ্রহণ করে। এর আগে, কুয়েতে (অন্যান্য উপসাগরীয় দেশগুলোর মতো) কেবলমাত্র বিশেষ আদালতের রায়ের মাধ্যমে রাজনৈতিক বিরোধীদের বা সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে অভিযুক্তদের নাগরিকত্ব বাতিল করা হতো।
কিন্তু ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে কুয়েত নতুন আইন পাস করে, যেখানে বলা হয়, “নৈতিক স্খলন, অসততা, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি বা আমিরের সমালোচনা করলে নাগরিকত্ব বাতিল করা যাবে”।
প্রতিদিন নাগরিকত্ব বাতিলের তালিকা প্রকাশ
সরকার একটি সুপ্রিম কমিটি গঠন করেছে, যা ঠিক করে কারা বৈধ নাগরিক এবং কারা নন। প্রতিদিন একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়, যেখানে নাগরিকত্ব হারানোদের নাম থাকে। এতে সাধারণ কুয়েতিরা আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন, নিজের বা পরিবারের নাম সেই তালিকায় আছে কি না, তা খুঁজে দেখছেন।
একদিনেই ৪৬৪ জনের নাগরিকত্ব বাতিল
২০২৫ সালের ৬ মার্চ মাত্র একদিনেই ৪৬৪ জনের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়।
- এর মধ্যে ১২ জনের বিরুদ্ধে “দ্বৈত নাগরিকত্ব” রাখার অভিযোগ আনা হয়েছে।
- ৪৫১ জনের বিরুদ্ধে “জালিয়াতি ও প্রতারণা”র অভিযোগ আনা হয়েছে।
নারীরা বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত
বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সেই নারীরা, যারা কুয়েতি পুরুষদের বিয়ে করে নাগরিকত্ব পেয়েছিলেন।
- তারা এখন রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়েছেন।
- তারা সরকারি স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক সুবিধা হারিয়েছেন।
- তাদের সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করানো যাচ্ছে না।
কুয়েতে দ্বৈত নাগরিকত্বের অনুমতি নেই। যারা নাগরিকত্ব হারিয়েছেন, তাদের অনেকে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে গেছে এবং ড্রাইভিং লাইসেন্সও বাতিল করা হয়েছে।
“আমাকে এক রাতেই রাষ্ট্রহীন বানিয়ে দিল”
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিনান্সিয়াল টাইমস একজন কুয়েতি ব্যবসায়ী ফয়সালের গল্প তুলে ধরেছে।
- তিনি বিমানবন্দরে আটক হন, এবং তার পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া হয়।
- পরে জানতে পারেন, তার পিতা ছিলেন “প্রাকৃতিকভাবে নাগরিকত্বপ্রাপ্ত”, এবং তিনিও নাগরিকত্ব হারিয়েছেন।
- ফয়সাল বলেন, “আমাকে এক রাতেই রাষ্ট্রহীন বানিয়ে দিল”।
- এখন তিনি দুবাইয়ে স্থায়ীভাবে বসবাসের পরিকল্পনা করছেন।
বিরোধীদের লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে
রাজনৈতিক বিরোধীরা বলছেন, এটি মূলত “প্রশাসনিক তদন্ত”র নামে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা।
বিশেষ করে সরকারের প্রতি আনুগত্যহীন কিছু উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর মানুষদের টার্গেট করা হচ্ছে।
বিদূনদের (Bidoon) সংকট আরও বাড়ছে
এটি কুয়েতে “বিদূন” (Bidoon) নামক এক বিশেষ শ্রেণির মানুষদের অবস্থা আরও সংকটাপন্ন করে তুলেছে।
- বিদূনরা মূলত যাযাবর উপজাতির বংশধর, যারা বছরের পর বছর নাগরিকত্ব পেতে ব্যর্থ হয়েছে।
- বর্তমানে ১,০০,০০০ বিদূন জনগোষ্ঠী কুয়েতে বসবাস করছে।
- তাদেরকে কোনো নাগরিক স্বীকৃতি দেওয়া হয় না এবং অধিকাংশ মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হয়।
বিদেশিদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদী প্রচারণা
সরকার বলছে, বিদেশিরা কুয়েতের সুবিধা ভোগ করছে, যা আসলে জাতীয়তাবাদী প্রচারণার অংশ।
কুয়েতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ ফাহাদ আল-ইউসুফ মার্চ মাসে আলরাই টিভি-তে বলেন:
- “আমি কোনো নির্দিষ্ট জাতীয়তার নাম নেব না, তবে কিছু বিদেশি জাতিগোষ্ঠী কুয়েতি সমাজের মূল চরিত্র নষ্ট করছে।”
- “এই জাতিগোষ্ঠীগুলো আমাদের সংস্কৃতি, ভাষা ও সামাজিক সম্পর্ক নষ্ট করছে।”
সরকার একটি হটলাইন চালু করেছে, যেখানে কুয়েতিদের বলা হয়েছে “যারা দ্বৈত নাগরিকত্ব ধারণ করেছে, তাদের রিপোর্ট করতে”।
অর্থনৈতিক মন্দার অজুহাত?
কুয়েতের অর্থনীতি অবনতি ঘটছে, এবং সরকার দাবি করছে,
- “এই ব্যবস্থাগুলো নেওয়া হচ্ছে রাষ্ট্রীয় ব্যয় কমানোর জন্য।”
- “কম নাগরিক থাকবে মানে কম লোক সরকারী সুবিধা পাবে।”
সংসদ বাতিল, কিন্তু অর্থনৈতিক সংস্কার নেই
ক্ষমতায় আসার পর আমির মিশাল প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন “অর্থনৈতিক সংস্কার” করবেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত ছিল নাগরিকত্ব বাতিল করা।
সংক্ষেপে:
✔ ৪২,০০০ মানুষ ছয় মাসে নাগরিকত্ব হারিয়েছে।
✔ নারী, রাজনৈতিক বিরোধী, উপজাতীয় জনগোষ্ঠী বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।
✔ সরকার “বিদেশিদের” বিরুদ্ধে বর্ণবাদী প্রচারণা চালাচ্ছে।
✔ অর্থনৈতিক সংকটের কারণে এই সিদ্ধান্তকে ন্যায্যতা দেওয়া হচ্ছে।
কুয়েতে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কোথায় গড়াচ্ছে? এটাই এখন বড় প্রশ্ন।