শনিবার ইসরায়েল লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে বিগত চার মাসের মধ্যে সবচেয়ে তীব্র বিমান হামলা চালিয়েছে। এই হামলা লেবানন থেকে ইসরায়েলের দিকে রকেট হামলার প্রতিক্রিয়ায় চালানো হয়, যা গত নভেম্বরের অস্ত্রবিরতির পর প্রথমবারের মতো ঘটেছে।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, তারা হিজবুল্লাহর বেশ কয়েকটি রকেট লঞ্চার এবং একটি কমান্ড সেন্টারে হামলা চালিয়েছে। হিজবুল্লাহ ইরান-সমর্থিত একটি মিলিশিয়া ও রাজনৈতিক সংগঠন, যা দক্ষিণ লেবাননে সক্রিয়।
লেবাননের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরায়েলি বিমান হামলায় এক শিশু সহ দুইজন নিহত হয়েছে এবং আটজন আহত হয়েছে। তবে হিজবুল্লাহ দাবি করেছে যে, তারা ইসরায়েলের দিকে কোনো রকেট হামলা চালায়নি। লেবানন সরকার জানিয়েছে, এই বিষয়ে একটি তদন্ত শুরু হয়েছে।
এই হামলা এমন এক সময়ে হলো যখন ইসরায়েল গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে তাদের সামরিক অভিযান আরও জোরদার করেছে। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, উত্তরের মেতুলা শহরের দিকে ছোড়া তিনটি রকেট তারা প্রতিহত করেছে এবং এতে কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি।
লেবাননের সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, তারা দক্ষিণাঞ্চলে তিনটি রকেট লঞ্চার নিষ্ক্রিয় করেছে এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জানিয়েছেন, রকেট হামলার বিষয়ে তদন্ত চলছে।
নাজুক অস্ত্রবিরতির পর সবচেয়ে বড় সহিংসতা
গত ১৪ মাস ধরে চলা সংঘাতের অবসান ঘটাতে যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের মধ্যস্থতায় একটি অস্ত্রবিরতি চুক্তি হয়েছিল, যার আওতায় লেবাননের সামরিক বাহিনী দক্ষিণাঞ্চলে সেনা মোতায়েনের প্রতিশ্রুতি দেয়। হিজবুল্লাহর যোদ্ধাদের ওই অঞ্চল থেকে সরে যাওয়ার কথা ছিল, আর ইসরায়েলি সেনারা দখলকৃত এলাকাগুলো থেকে প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি দেয়।
তবে ইসরায়েল প্রতিদিন হিজবুল্লাহর লক্ষ্যবস্তুতে বিমান হামলা চালিয়ে আসছে এবং বলছে, তারা এই হামলা চালিয়ে যাবে যাতে হিজবুল্লাহ পুনরায় অস্ত্র সংগ্রহ করতে না পারে। বর্তমানে ইসরায়েলি বাহিনী দক্ষিণ লেবাননের পাঁচটি স্থানে অবস্থান করছে, যা লেবানন সরকার তাদের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন বলে দাবি করছে।
শনিবারের হামলার ফলে লেবাননের সরকারের ওপর চাপ আরও বৃদ্ধি পাবে। ইসরায়েল দাবি করতে পারে যে, লেবাননের সামরিক বাহিনী দক্ষিণাঞ্চলে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছে, যেখানে ঐতিহ্যগতভাবে হিজবুল্লাহর শক্তিশালী উপস্থিতি রয়েছে।
লেবাননের প্রেসিডেন্ট জোসেফ আউন বলেছেন, দেশের অভ্যন্তরে শুধুমাত্র রাষ্ট্রের বাহিনীরই অস্ত্র থাকার অধিকার আছে, যা হিজবুল্লাহর অস্ত্রভাণ্ডারকে ইঙ্গিত করছে। প্রধানমন্ত্রী নাওয়াফ সালামও সতর্ক করেছেন যে, এই উত্তেজনা দেশকে আরেকটি যুদ্ধে ঠেলে দিতে পারে।
জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনী (ইউনিফিল) উদ্বেগ প্রকাশ করে উভয় পক্ষকে তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার আহ্বান জানিয়েছে।
হিজবুল্লাহর চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ
ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতে হিজবুল্লাহ বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে। তাদের বহু নেতা নিহত হয়েছে, শত শত যোদ্ধা প্রাণ হারিয়েছে এবং তাদের অস্ত্র ভাণ্ডারের একটি বড় অংশ ধ্বংস হয়েছে। একই সঙ্গে, যুদ্ধকবলিত অঞ্চলে বসবাসকারী জনগণের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান ও প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর চাপ মোকাবিলা করাও তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
লেবাননের আন্তর্জাতিক মিত্ররা বলছে, তারা কেবল তখনই দেশকে সহায়তা করবে যদি সরকার হিজবুল্লাহর ওপর কঠোর ব্যবস্থা নেয়।
হিজবুল্লাহ ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পরদিনই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তাদের অভিযান শুরু করেছিল, ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি প্রকাশের অংশ হিসেবে। এরপর সংঘাত ক্রমশ বেড়ে গিয়ে ইসরায়েলের ব্যাপক বিমান হামলা ও দক্ষিণ লেবাননে স্থল অভিযান পর্যন্ত গড়ায়।
এই সংঘাতে লেবাননে প্রায় ৪,০০০ মানুষ নিহত হয়েছে, যার বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক। এছাড়া, ১২ লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
ইসরায়েলের মূল লক্ষ্য ছিল হিজবুল্লাহর সীমান্ত এলাকা থেকে সরে যাওয়া নিশ্চিত করা এবং নিজেদের উত্তরাঞ্চল থেকে বাস্তুচ্যুত প্রায় ৬০,০০০ বাসিন্দার প্রত্যাবর্তন সম্ভব করা। তবে সাম্প্রতিক উত্তেজনা ইঙ্গিত দিচ্ছে, সংঘাতের নতুন অধ্যায় শুরুর ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।