গাজা, ২১ জুলাই ২০২৫ – গাজার উত্তরে জাতিসংঘের সাহায্যবাহী ট্রাকের সামনে অপেক্ষমান শত শত ক্ষুধার্ত মানুষের ওপর ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিবর্ষণে অন্তত ৬৭ জন নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে হামাস-নিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এই মর্মান্তিক ঘটনার পর মানবিক পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (World Food Programme) এক বিবৃতিতে জানায়, তাদের ২৫ ট্রাকের একটি কনভয় যখন ইসরায়েলি চেকপয়েন্ট পার হয়ে গাজা প্রবেশ করে, তখন সেটি বিশাল এক ক্ষুধার্ত মানুষের ভিড়ের মুখে পড়ে এবং গুলিবর্ষণের শিকার হয়। সংস্থাটি এই ধরনের সহিংসতাকে “পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য” বলে উল্লেখ করেছে।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (IDF) দাবি করেছে, তারা “তাৎক্ষণিক হুমকি” মোকাবেলায় “সতর্কতামূলক গুলি” চালিয়েছে। তবে তারা নিহতের সংখ্যা নিয়ে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দাবিকে অস্বীকার করেছে।
ক্ষুধা, আতঙ্ক ও মৃত্যু – গাজার বাস্তবতা
গত ২৪ ঘণ্টায় “ক্ষুধার কারণে” ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিন অসংখ্য শিশু, নারী ও পুরুষ চরম ক্লান্তি ও অপুষ্টি নিয়ে ভর্তি হচ্ছে। গাজার বৃহত্তম হাসপাতাল শিফা’র পরিচালক ডা. হাসান আল-শায়র জানান, “আমরা সম্পূর্ণ অভিভূত হয়ে পড়েছি। এত রোগী সামলানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
একজন নারী বিবিসি আরবিকে বলেন, “পুরো জনগণ ধীরে ধীরে মারা যাচ্ছে। শিশুরা শুধু লবণ ও পানি খেয়ে বেঁচে আছে। খাবার বলতে কিছু নেই।”
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে গাজায় প্রায় ৯০ হাজার নারী ও শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে এবং প্রতি তিন জনে একজন দিনে পর দিনে না খেয়ে থাকছে।
মরিয়া ভিড়, গুলি ও শিকার হওয়ার বর্ণনা
একজন বেঁচে ফেরা ব্যক্তি, কাসেম আবু খাতের, এএফপিকে বলেন, “আমি একটি ময়দার বস্তা নিতে গিয়েছিলাম, কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখি মৃত্যুপুরী। বিশাল ভিড়, ধাক্কাধাক্কি আর তারপর গোলাবর্ষণ ও গুলি – যেন আমরা জঙ্গলে শিকার হওয়া প্রাণী।”
তিনি আরও জানান, “অনেক মানুষ আমার চোখের সামনে মারা গেল। কাউকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।”
দেইর আল-বালাহতে নতুন হামলার শঙ্কা, গাজার মধ্যভাগেও সঙ্কট ঘনিয়ে আসছে
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী নতুন করে গাজার কেন্দ্রীয় শহর দেইর আল-বালাহের কিছু অংশ খালি করতে বলেছে। সেখানে এখনও স্থল অভিযান শুরু হয়নি, তবে বিমান হামলা চলছে। সামরিক বাহিনী জানায়, “শত্রুর ঘাঁটি ধ্বংস করতে আমরা কাজ করছি।”
এই নির্দেশে হাজার হাজার মানুষ, যাদের অনেকেই ইতিমধ্যে বারবার বাস্তুচ্যুত হয়েছেন, নতুন করে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। একইসঙ্গে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন ইসরায়েলি জিম্মিদের পরিবার, কারণ ধারণা করা হচ্ছে কিছু জিম্মি এখনো ঐ এলাকায় আটক রয়েছে।
যুদ্ধ ও ক্ষুধা – দুই বিপর্যয়ে বিপন্ন গাজা
গত ২১ মাস ধরে চলমান যুদ্ধে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসেব অনুযায়ী ইতোমধ্যে ৫৮,৮৯৫ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী ও শিশু।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বলছে, এই মানবিক বিপর্যয় ইতিহাসে এক ভয়াবহ নজির হয়ে থাকবে, যেখানে জনগণ সহায়তা নিতে গিয়েও গুলির মুখে পড়ছে, আর খাদ্যের অভাবে শিশুরা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও আহ্বান
পোপ লিও ১৪তম বলেছেন, “এই যুদ্ধের নৃশংসতা অবিলম্বে বন্ধ হওয়া উচিত। নির্বিচারে শক্তি প্রয়োগ কোনো সভ্যতার পরিচয় হতে পারে না।” তিনি সম্প্রতি গাজার একমাত্র ক্যাথলিক গির্জায় ইসরায়েলি হামলায় হতাহতের ঘটনায় গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন।
এই মুহূর্তে গাজা যেন একটি রক্তাক্ত খোলা wound – যেখানে যুদ্ধ, ক্ষুধা ও ভ্রাতৃত্বহীনতা একসাথে রক্ত ঝরাচ্ছে। মানবতার এই চরম দুর্দশা আন্তর্জাতিক সমাজের জন্য একটি বড় প্রশ্নচিহ্ন হয়ে রইল: একবিংশ শতাব্দীতে আমরা কীভাবে একজন মানুষের জীবনের জন্য নিরাপদ খাদ্যটুকুও নিশ্চিত করতে পারি না?