হরিপুর (ঠাকুরগাঁও)প্রতিনিধি:
বাঁশের তৈরি জিনিসপত্র তৈরি করে জীবিকার প্রধান উৎস হিসেবে এই শিল্পকে টিকিয়ে রেখেছে ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুরের প্রায় অর্ধশত পরিবার। এই বাঁশের তৈরি আসবাবপত্র বর্তমানে তাদের জীবিকার প্রধান বাহক।
বাঁশ আর শুধু গ্রামীণ জীবনের প্রতীক নয় এখন এটি কোটি টাকার সম্ভাবনাময় বাণিজ্যিক ফসল। প্রতি বছর ১৮ সেপ্টেম্বর বিশ্বজুড়ে পালিত হয় বিশ্ব বাঁশ দিবস। ২০০৯ সালে ব্যাংককে অনুষ্ঠিত অষ্টম বিশ্ব বাঁশ কংগ্রেসে দিনটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাঁশ দিবস ঘোষণা করা হয়। এ বছর পালিত হচ্ছে এর ১৯তম আয়োজন। বিশ্ব বাঁশ দিবস ২০২৫ এর প্রতিপাদ্য: “নেক্সট জেনারেশন ব্যাম্বো: সলিউশন, ইনোভেশন অ্যান্ড ডিজাইন”।
বাংলাদেশে দীর্ঘদিন বাঁশ নিয়ে আলোচনা হতো অবহেলার সুরে। কিন্তু এখন চিত্র বদলেছে। দেশের নানা প্রান্তে বাঁশের বাণিজ্যিক চাষ শুরু হয়েছে। বহুমুখী ব্যবহার আর দ্রুত বৃদ্ধি ক্ষমতা বাঁশকে করে তুলেছে কোটি টাকার আয়ের উৎস।
বাঁশ আসলে গাছ নয়, এটি এক প্রকার ঘাস। উন্নত বিশ্বে কাঠের বিকল্প হিসেবে বাঁশের ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে। একে বলা হয় ‘গ্রিন গোল্ড’ বা সবুজ সোনা। বাঁশ ও বেত পৃথিবীর সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব উদ্ভিদের মধ্যে অন্যতম। যেখানে একটি গাছ পরিপক্ব হতে ৩০–৪০ বছর সময় নেয় এবং কেটে ফেললে জীবনচক্র শেষ হয়ে যায়, সেখানে বাঁশ মাত্র ৪–৫ বছরেই প্রস্তুত হয়। পরিপক্ব বাঁশ কাটলে গোড়া থেকে অসংখ্য নতুন বাঁশ জন্ম নেয় এই চক্র চলতে থাকে যতক্ষণ না বাঁশঝাড়ে ফুল আসে।
বিশ্বজুড়ে রয়েছে ১ হাজার ৬৭৮ প্রজাতির বাঁশ, যার মধ্যে বাংলাদেশে আছে প্রায় ৩০–৪০ প্রজাতি। বান্দরবানের লামায় কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে সংগ্রহ করা ২০০-রও বেশি প্রজাতির বাঁশের অনন্য সংগ্রহশালা গড়ে তুলেছে। উপযুক্ত পরিবেশে বাঁশ দিনে ৩ ফুট বা ৩৬ ইঞ্চি পর্যন্ত বাড়তে পারে। এটি গাছের তুলনায় ২০–৩৫ শতাংশ বেশি অক্সিজেন উৎপাদন করে এবং বেশি কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্রহণ করে। সঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাত করলে বাঁশের তৈরি পণ্য ৫০ বছর বা তার বেশি সময় ব্যবহার করা সম্ভব।
বাঁশের ব্যবহারিক প্রয়োগ অন্তত ৮০টিরও বেশি ক্ষেত্রে। গ্রামীণ সমাজে ঘরের কাঠামো, ছাউনি, সাঁকো, মই, ঝুড়ি, মাদুরসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তৈরিতে বাঁশ অপরিহার্য। হস্তশিল্প ও কুটিরশিল্পে বাঁশের অবদান অসীম। উষ্ণমণ্ডলীয় দেশগুলোয় কাগজ তৈরির মূল কাঁচামালও বাঁশ। খাদ্য হিসেবেও এর চাহিদা আছে পার্বত্য অঞ্চলে তরুণ বাঁশের কুঁড়ি বা ‘কোড়ল’ জনপ্রিয় খাদ্য উপাদান; সুপ, সালাদ ও তরকারিতে এর স্বাদ বিশেষভাবে পছন্দের। চীন, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম বাঁশের ব্যবহারকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে হাতের কাজ থেকে স্থাপত্য, সবখানেই নতুন উদ্ভাবন হচ্ছে।
কোয়ান্টাম ব্যাম্বোরিয়ান্সের কিউরেটর সাইফুদ্দিন সাইফ জানান, “বিশ্ব বাঁশ দিবসে আমরা বান্দরবানের লামায় ৪ হাজার বাঁশ রোপণ করছি। বাণিজ্যিক বিপণন মাথায় রেখেই আমরা বাঁশবাগান তৈরি করছি। ৭০–৮০ বিলিয়ন ডলারের বিশ্ব বাঁশবাজারে বাংলাদেশের অংশীদার হওয়াই আমাদের লক্ষ্য।”
বাঁশ তাই আর স্রেফ গ্রামীণ জীবনযাপনের অংশ নয় এটি দ্রুতবর্ধনশীল, পরিবেশবান্ধব এক সম্পদ, যা বাংলাদেশের অর্থনীতি ও শিল্পে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে পারে।