রুশাইদ আহমেদ, বেরোবি প্রতিনিধি:
রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (বেরোবি) ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে তিনটি বিভাগের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে অন্তত ১১ জন আহত হয়েছেন, তাদের মধ্যে দুজনের অবস্থা গুরুতর। এ ঘটনায় আট শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
সোমবার (১৩ অক্টোবর) রাত আটটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে মার্কেটিং, পদার্থবিজ্ঞান ও পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থীরা এ সংঘর্ষে জড়ান।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সম্প্রতি শেষ হওয়া জেন-জি আন্তঃবিভাগ ফুটবল টুর্নামেন্টের একটি ম্যাচে মার্কেটিং ও পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থীদের মাঝে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। তার রেশ ধরে সোমবার পরিসংখ্যান বিভাগের কতিপয় শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকটবর্তী চকবাজার এলাকায় মার্কেটিং বিভাগের ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের এক শিক্ষার্থীকে মারধর করেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মার্কেটিংয়ের শিক্ষার্থীকে মারধরের ঘটনা জানাজানি হলে পরিসংখ্যান বিভাগের অন্যান্য শিক্ষার্থীরা মার্কেটিং বিভাগের ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সমঝোতা করতে শহীদ আবু সাঈদ চত্বরে আসেন। তখন বিভাগ দুটির শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা করেন। এতে পরিসংখ্যান বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী প্রান্ত ঘোষ মাথায় গুরুতর জখম হন। পরে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা আরও জানান, এ ঘটনার পরপর বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে। মার্কেটিং বিভাগের সঙ্গে পরিসংখ্যান বিভাগের দফায় দফায় সংঘর্ষের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। ভাঙচুর করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে প্রধান ফটকের ভেতরের পাশে রাখা কিছু ছবির ফ্রেমও।
এরপর বিভাগ দুটির উত্তেজিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। এ সময়, স্বাধীনতা স্মারক মাঠে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ইউসুফ আলী নামের এক শিক্ষার্থী আতঙ্কে সংঘর্ষস্থল থেকে পালাতে গেলে মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা অকস্মাৎ তার ওপর চড়াও হন। লাঠিসোঁটা দিয়ে পিটানো হয় তাঁকে। এতে খবর পেয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরাও একত্রিত হয়ে প্রধান ফটক দিয়ে মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দিলে তাঁরা পিছু হটে একাডেমিক ভবন ৩ এর সামনে অবস্থান নেন।
পরে পদার্থবিজ্ঞান ও পরিসংখ্যান বিভাগের কয়েক শতাধিক শিক্ষার্থী একযোগে ধাওয়া দিলে মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা প্রাণভয়ে একাডেমিক ভবন ৩ এর ভেতরে গিয়ে বিভিন্ন শ্রেণিকক্ষ ও টয়লেটে অবস্থান নেন। ভবনটির গেইটে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় তালা।
সে সময়, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. মো. ফেরদৌস রহমান, ছাত্র পরামর্শ ও নির্দেশনা দপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. ইলিয়াছ প্রামানিক ও রেজিস্ট্রার ড. মো. হারুন-অর-রশিদসহ প্রক্টরিয়াল বডি এবং ছাত্রনেতারা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে শিক্ষার্থীদের উত্তেজনা প্রশমনের চেষ্টা করেন। কিন্তু সে দিকে কান না দিয়ে পদার্থবিজ্ঞান ও পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থীরা সম্মিলিতভাবে ভবনটির তালা খুলে নিচতলায় থাকা রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শ্রেণিকক্ষের দরজা-জানালা ভাঙচুর করেন। এ সময়, মার্কেটিং বিভাগের ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের নিলয় নামের এক শিক্ষার্থী চোখে মারাত্মকভাবে জখম হন। সংঘর্ষ থামার পর তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়।
এ দিকে, পরিস্থিতি সামাল দিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুলিশ ক্যাম্পের পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলে যান রাত সাড়ে ৯টার দিকে। তবে পর্যাপ্ত জনবলের অভাবে তাঁরা তেমন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেননি। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শওকাত আলীও ঘটনাস্থলে গিয়ে উত্তেজিত শিক্ষার্থীদের শান্ত করতে ব্যর্থ হন। সোমবার দিবাগত রাত ১২টার দিকেও ভবনটির সামনে পরিসংখ্যান ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের উত্তেজিত শিক্ষার্থীরা অবস্থান নিয়ে প্রশাসনের কাছে এমন ন্যাক্কারজনক হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ করতে থাকেন। মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা তখনও একাডেমিক ভবন ৩ এর ভেতর অবরুদ্ধ অবস্থায় ছিলেন।
অপর দিকে, উদ্ভূত সংকট নিরসনে মধ্যরাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জরুরি মিটিংয়ে বসে প্রশাসনিক ভবনের কনফারেন্স রুমে। পরে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে মার্কেটিং বিভাগের আট শিক্ষার্থীকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বহিষ্কারের কথা জানান উপাচার্য।
বেরোবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শওকাত আলী বলেন, পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী ইউসুফের ওপর অতর্কিত হামলার ঘটনার মূল সূত্রপাত ঘটানোর দায়ে মার্কেটিং বিভাগের ১৬তম ব্যাচের (২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের) সাফায়েত শুভ এবং শাহরিয়ার অপুকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে তাদের সহযোগিতা করা সজীব, সৌরভ, নাজমুস সাকিব, রোহান সরকার, জিহাদ এবং ১৪তম ব্যাচের (২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের) আশরাফুলকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হবে।
তিনি আরও বলেন, এ ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জিরো টলারেন্স নীতির অনুসরণ করবে। বহিষ্কার মানে (অনির্দিষ্টকালের জন্য) বহিষ্কার। কোনো সেমিস্টারের আলাপ এখানে নেই। বিশ্ববিদ্যালয়কে কলঙ্কমুক্ত করা জন্য “এ ধরনের কীটকে” বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করতে হবে বলেও মন্তব্য করেন ড. শওকাত আলী।
একইসঙ্গে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভাঙচুরের ঘটনায় শিক্ষার্থীদেরকে সতর্ক করে তিনি বলেন, আমি তোমাদের অ্যালার্ট করে দিতে চাই—ভবিষ্যতে কেউ যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদের ক্ষতি সাধন না করে। বিভাগ দুটিতে ভাঙচুরের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এ সময়, এ ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত সকল বিষয় তদন্ত করতে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানান উপাচার্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পরামর্শ ও নির্দেশনা দপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. ইলিয়াছ প্রামানিক এবং প্রক্টর ড. মো. ফেরদৌস রহমান এ কমিটির আহ্বায়ক এবং সদস্যসচিব হবেন। সদস্য হিসেবে কাজ করবেন প্রকৌশল অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান, বিজয় ২৪ হলের প্রভোস্ট ড. আমির শরীফ এবং জীব ও ভূবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. এমদাদুল হক।
এ দিকে, এই সংঘর্ষের কারণে তাৎক্ষণিক আট শিক্ষার্থীকে বহিষ্কারের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অধিকাংশ শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসের সুষ্ঠু পরিবেশ রক্ষায় প্রশাসনের এমন সিদ্ধান্তের প্রশংসা করলেও, কিছু শিক্ষার্থী বলছেন পরিপূর্ণ তদন্ত শেষে সবকিছু বিবেচনা করা উচিত।
এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মো. মাসুদ রানা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ধরনের উগ্র-উচ্ছৃঙ্খল আচরণ কোনোভাবেই কাম্য নয়। সে দিক থেকে বলতে গেলে এ ধরনের বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত যথার্থ বলেই মনে হয় আমার কাছে, তারা যে পক্ষেরই হোক না কেন।
তিনি আরও বলেন, তবে অনির্দিষ্টকালের জন্য বহিষ্কারের যে সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়েছে, সেটি হয়তো তাৎক্ষণিক ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনার ভিত্তিতে নেওয়া হয়েছে। অথচ জুলাই আন্দোলনে এ ধরনের উগ্র হামলার ঘটনায় তৎকালীন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অনেককে শুধু এক বা দুই সেমিস্টারের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। এটার যৌক্তিকতা কতটুকু তা সুষ্ঠু তদন্তের পর সবকিছু ন্যায্যভাবে বিবেচনার আহ্বানও জানান তিনি।