মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ
পরাক্রমশালী রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াসের শাহী দরবার। চারদিকে পিনপতন নীরবতা। সম্রাটের হাতে এক অদ্ভুত চিঠি— প্রেরক একজন মেষপালক, দূর আরবের সবুজ বাগানের এক মালী। তাঁর নাম মুহাম্মাদ। চিঠিতে তাওহীদের ডাক, আল্লাহর একত্ববাদের প্রতি পূর্ণ সমর্পণের আহ্বান। আশ্চর্যের বিষয়, যিনি চিঠি পাঠিয়েছেন তিনি নিজে লিখতে-পড়তে জানেন না!
সম্রাট বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলেন। চিঠির কোথাও তার প্রশংসা নেই। যেখানে অন্য সাম্প্রতিক সব চিঠি ভরে থাকে সম্রাটের বিজয়গাথায়, প্রশংসার প্রশংসায় চিঠির বিষয়বস্তুই খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে পড়ে। অথচ এই পত্রের শুরুতেই অদ্ভুত এক টান, যেন মোহনীয় কোনো শক্তি। প্রথম লাইনেই লেখা— “পরম করুণাময় আল্লাহর নামে শুরু করছি।”
কিছুদিন আগেই রোম সাম্রাজ্য ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। পারস্য সম্রাট পারভেজ একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ নগর দখল করে নিচ্ছিল। শহরের ফটকে ফটকে ঝুলছিল রোমান সৈন্যদের নিথর দেহ। ক্ষুধার তাড়নায় মানুষ গাছের বাকল খাচ্ছিল, স্বেচ্ছায় দাসত্ব বরণ করে নিচ্ছিল রোমান নারীরা। পারস্য সেনারা পৌঁছে গিয়েছিল রাজধানীর খুব কাছে। হিরাক্লিয়াস নিজেও পরাজয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ইতিহাস থেকে মুছে যাওয়ার অপেক্ষা করছিল রোম সম্রাজ্য। সেই সময়ে নবুওতের দাবিদার এই আরব মেষপালক ওহীর মাধ্যমে ঘোষণা করেছিলেন— রোমরা অচিরেই বিজয় লাভ করবে। তাঁর উপর অবতীর্ণ কিতাবে জানানো হলো সেই পূর্বাভাস। অবিশ্বাস্য হলেও তা সত্যি হযয়েছে! আজ রোমের সিংহাসনে বিজয়ীর আসনে বসে আছেন হিরাক্লিয়াস। তার শত্রুরা চরমভাবে লাঞ্চিত ও পরাজিত হয়েছেন।
এমন এক মানুষ এখন তাঁকে আহ্বান জানাচ্ছেন ইসলামের দিকে! সভাসদরা ভেবেছিলেন সম্রাট ক্ষিপ্ত হবেন। বার্তাবাহককে শাস্তি দিবেন। কিন্তু সকলকে অবাক করে দিয়ে তিনি ঘোষণা দিলেন— “যেখানেই আরব অভিযাত্রী পাবে, তাদের সম্মানের সাথে দরবারে নিয়ে আসবে। মনে রেখো, তারা কাইজারের অতিথি।”
ঠিক তখনই, বাণিজ্য কাফেলা নিয়ে আবু সুফিয়ান গাজা*য় অবস্থান করছিলেন। কাইজারের লোকেরা তাকে জে*রু*জা*লে*মে*র প্রাসাদে নিয়ে এলো। দরবারের জাঁকজমক দেখে আরব বণিকেরা হতবাক, কেউ কেউ ভীতও।
সম্রাট দরাজ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন—
—তোমাদের মধ্যে নবুওতের দাবিদারের আত্মীয় কেউ আছো?
সবার চোখ গিয়ে থামল আবু সুফিয়ানের উপর।
—“আমি”। কাঁপা গলায় উত্তর দিলেন তিনি।
শুরু হলো সম্রাটের প্রশ্নবান,
—সে নবীর বংশ কেমন?
—আরবের সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান সে। তার দাদা খানায় ক্বাবার চাবিবাহক।
—এর আগে কি তাঁর বংশে কেউ নবুয়তের দাবি করেছিল?
—না।
—তাদের মধ্যে কেউ কি কখনো রাজা হয়েছিল?
—না।
—তারা মুহাম্মাদের ধর্ম গ্রহণ করছে— শক্তিমান নাকি দুর্বলরা?
প্রশ্ন শুনে এক পা সামনে গেলেন আবু সুফিয়ান। সিনা টান করলেন। গলায় ফুটে উঠল আভিযাত্য ও গর্বের সুর।
—দুর্বল ও অসহায়রাই তার ধর্ম গ্রহণ করছে।
সম্রাট থামলেন। তীক্ষ্ণ চোখে তাকালেন আবু সুফিয়ানের দিকে। আবার প্রশ্ন করলেন,
—তাঁর অনুসারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে নাকি কমছে?
—বাড়ছে। মাথা নিচু করে উত্তর দিলেন আরব ব্যবসায়ী।
—তিনি কি প্রায় মিথ্যা বলেন?
—না, মাননীয় সম্রাট। সে অত্যন্ত সত্যবাদী। আমরা তাকে আল আমীন বলে ডাকতাম।
—প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছেন?
—কখনো করেননি।
—তাঁর সাথে তোমাদের যুদ্ধ হয়েছে?
—হয়েছে, কখনো আমরা জিতেছি, কখনো তিনি।
—তিনি মানুষকে কী শিক্ষা দেন?
—তিনি বলেন, ‘এক আল্লাহর ইবাদত করো, তাঁর সাথে কাউকে শরিক করো না। নামাজ পড়ো, সত্য কথা বলো, কন্যাশিশুদের জীবন্ত কবর দিও না, আত্মীয়দের সাথে সদ্ব্যবহার করো, নিজে সৎ হও।’
হিরাক্লিয়াস গভীর চিন্তায় মাথা নুইয়ে রইলেন। কপালে ভাঁজ, চোখে উদ্বেগের ছায়া। কিছুক্ষণ পর মাথা তুলে আবু সুফিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললেন—
“তুমি স্বীকার করেছ, তাঁর বংশ সম্ভ্রান্ত। নবীরা সর্বদা সম্ভ্রান্ত বংশেই জন্ম নেন। তুমি বলেছ, তাঁর বংশে কেউ নবুওতের দাবি করেনি, তারমানে এটা তার বংশগত দোষ নয়। তাঁর বংশে কখনো রাজা জন্মায়নি, সুতরাং তিনি রাজত্বের লোভী নন। তুমি স্বীকার করেছ, তিনি কখনো মিথ্যা বলেননি। যে মানুষ মিথ্যা বলে না, সে আল্লাহর নামেও মিথ্যা বলবে?”
এবার সভাসদদের দিকে তাকালেন হিরাক্লিয়াস। ঘোষণার সুরে বললেন, ‘আমরা জানি, নবীদের অনুসরণ করে সর্বপ্রথম অসহায় আর নিঃস্বরা, আর তাদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকে। নবীরা প্রতারণা করেন না। তারা কল্যাণের পথে আহ্বান করেন, সৃষ্টিকর্তার ইবাদতে ডাকেন।’
সম্রাটের গলা কেমন মিইয়ে গেল। নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমরা নিশ্চিত থাকো, আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, একদিন এই জমিন পর্যন্ত তার অধীনস্ত হবে। আমি জানতাম একজন শেষ নবী আসবেন। ধারণা করেছিলাম তিনি আমাদের কওমে আসবেন। কিন্তু তিনি এসেছেন আরবে। তাঁর কাছে যেতে পারলে আমি তাঁর পা ধুয়ে দিতাম।’
বাংলাদেশের প্রান্ত থেকে সালাম জানাই হে রাসুল (স:)।