দিনাজপুর প্রতিনিধি:
দিনাজপুর শহরের ৮ নম্বর নিউ টাউন হাউজিং মোড়। বাইরের দিক থেকে সাধারণ একটি বেসরকারি যক্ষা রোগ নির্ণয় কেন্দ্র। দরজায় ব্রাকের লোগো, ভেতরে রোগ খোঁজার ল্যাব—সবকিছুই যেন নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবারই অংশ। কিন্তু পর্দার আড়ালে চলছিল একটি ভয়ংকর প্রতারণা, যা শুধু সরকারি ওষুধ নয়—হামলা করছিল মানুষের বিশ্বাসের ওপর।
ছোটবেলায় অনেকেই শুনেছেন—“যক্ষ্মা হলে রক্ষা নেই।” কিন্তু এখন বাস্তবতা আরও কঠিন—যক্ষ্মা রোগ নির্ণয়ের নামে সুস্থ মানুষকে অসুস্থ বানানো, আর সরকারি ওষুধ দিয়ে নতুন ব্যবসা। এই যক্ষা রোগ নির্ণয় কেন্দ্রটিকে ঘিরেই দীর্ঘদিন ধরে উঠছিল গুঞ্জন।
ব্রাকের সহায়তায় পরিচালিত যক্ষা রোগ নির্ণয় কেন্দ্রটি বাংলাদেশ সরকার তথা জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ। নিয়ম অনুসারে, তারা রোগীর কফ পরীক্ষা করে যক্ষ্মা শনাক্ত করলে রিপোর্ট পাঠাবে, আর সেই অনুযায়ী জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় ওষুধ সরবরাহ করবে।
কিন্তু কয়েক মাস ধরে রোগী তালিকা আর ওষুধ বরাদ্দের হিসাব মিলছিল না। ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. শাহ মোহাম্মদ শরীফ সন্দেহজনক রিপোর্ট পেয়ে কেন্দ্রটির ম্যানেজার রেজাউল কবিরকে কয়েকবার সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু কোনো পরিবর্তন হয়নি।
অবশেষে ১ ডিসেম্বর সকাল—তিনি নিজেই মাঠে নামলেন। আর তখনই শুরু হলো চাঞ্চল্যকর তথ্য উন্মোচনের অভিযান।
গত সোমবার দুপুরে ডেপুটি সিভিল সার্জন যান শহরের কুঞ্জবাড়ি এলাকায়। তালিকা অনুযায়ী দীপ্তি রানী যক্ষা রোগী, যার নামে তিন মাস ধরে ওষুধ বের হয়েছে।
দরজায় কড়া নাড়তেই বিস্মিত দীপ্তি রানী বললেন, আমি তো যক্ষা রোগে আক্রান্ত নই । আমার কোন ঔষধ প্রয়োজন হয় না। তাই কোনো ওষুধও খাই না।
দীপ্তি রানীর ছেলেও হতভম্ব—মায়ের যক্ষা? আমি তো ডাক্তারদের সঙ্গে কাজ করি, এ কথা আজই প্রথম শুনছি!
একই সময় পাশের বাড়ি থেকে এসে দাঁড়ালেন দিপালী রানী—তিনিও তালিকায় যক্ষা রোগী। তার উত্তরও একই—
“আমার কখনো যক্ষা হয়নি, তবু কেন আমার নামে ওষুধ?”
তিনি জানালেন, এলাকার এক নারী—ইতি রানী নামক নারী একদিন তার কফ সংগ্রহ করেছিল। কেন নিয়েছিল, তিনি জানেন না।
এই তদন্তের মাঝেই সাক্ষাৎ পাওয়া গেল সেই ইতি রানীর। প্রথমে এড়িয়ে গেলেও পরে এসে তিনি বললেন—হাউসিং মোড়ের যক্ষা রোগ নির্ণয় কেন্দ্রের হোসনে আরা আপা আমাকে এক হাজার টাকা করে টাকা দিয়ে যায়। আর আমাকে কিছু ওষুধও দেয়। আমি সেগুলো কয়েকজনকে খাইয়ে দেই।
আরও বড় চমক—ইতি রানীর স্বামী বলরাম রায়ের নম্বর দেওয়া ছিল রোগী তালিকায়। সেখানে ফোন করলেই অপরপ্রান্ত থেকে বলা হয়—হ্যাঁ, রোগীদের ওষুধ খাইয়ে দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু কোন কোন রোগীকে প্রশ্ন করলেই ফোন কেটে দেওয়া হত।
দিনাজপুর পৌর সভার গুঞ্জবাড়ির আরেক বাসিন্দা রিয়াজুল ইসলাম (৬০) তালিকায় যক্ষা রোগী। তিনি জানান—
“ইতি রানী আমার কফ নিয়া গেছিল। পরে আমাকে হাউজিং মোড়ে যক্ষা রোগ নির্ণয় কেন্দ্রে নিয়ে যায়। ওরা বলে আমার যক্ষা হইছে। ১৫ দিন ওষুধ খাইছিলাম। এতে শরীর খারাপ হয়ে গেলে বন্ধ করি। এখনো আমার নামে নাকি ওষুধ আসে!”
তিনি আরোও নিশ্চিত—
“আমার যক্ষা হয়নি। আমাকে জোর করে রোগী বানাইছে।
এরপর ডেপুটি সিভিল সার্জন সরাসরি হাজির হন যক্ষা রোগ নির্ণয় কেন্দ্রে। প্রথমে কাউকে না পেলেও মাঠকর্মী জিন্নাত আরা আসেন। ম্যানেজার রেজাউল কবিরকে ডাকা হলে তিনি নানা অজুহাত দেন। পরে উপস্থিত হয়ে উল্টো উত্তেজিত হয়ে ওঠেন, তার স্টাফদের বললেন—
“সবাই অফিস ছাড়ো!”এমনকি সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে অকথ্য ভাষায় তর্কে জড়ান।
অবস্থা বেগতিক দেখে সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি পুলিশ ও প্রশাসনকে জানানো হয়। ডিবি পুলিশের টিম এসে কেন্দ্রের ভেতর তল্লাশি শুরু করে।
গোপন কক্ষে মিলল ‘ওষুধের পাহাড়’ আর ফ্রিজে জমাট বাধা কফ। তল্লাশিতে বেরিয়ে আসে একের পর এক চাঞ্চল্য—পরিত্যক্ত কক্ষ থেকে বিপুল পরিমাণ সরকারি যক্ষা নিরাময়ের ওষুধ, ফ্রিজে সংরক্ষিত কফের স্টক,
যেসব কফ স্যাম্পলে আগে থেকেই যক্ষ্মার ব্যাকটেরিয়া ছিল, সেগুলো নাকি নতুন রোগীর কফের সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হতো। অর্থাৎ যারা সুস্থ, তাদের কফে যক্ষ্মার জীবাণু মিশিয়ে তৈরি করা হতো ‘পজিটিভ’ রিপোর্ট। কারণ—যত রোগী, তত প্রকল্পের অর্থ; আর যত ওষুধ, তত অবৈধ বাজার।
কর্মকর্তারা নিশ্চিত হন, একদল কর্মকর্তা-কর্মচারী দীর্ঘদিন ধরে সুস্থ মানুষের কফে ইচ্ছাকৃতভাবে রোগ মিশিয়ে যক্ষ্মা বানিয়ে দিচ্ছিল।
জেলা প্রশাসকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আরিফ সুলতান ভ্রাম্যমাণ আদালতে ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করেন।
অভিযানে প্রমাণ মেলায় রাতেই মধ্যেই ভ্রাম্যমাণ আদালত বসান জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আরিফ সুলতান।
যক্ষা রোগ নির্ণয় কেন্দ্র জেলা ম্যানেজার রেজাউল কবির,সদর ম্যানেজার নয়ন কুমার রায়, এফও হোসনে আরা বেগম,এফও আজিজুর রহমান সহ মোট ৮ জন কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হয়।
যক্ষা রোগ নির্ণয় কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রেজাউল কবির অপরাধ স্বীকার করায় ভ্রাম্যমান আদালত ৪০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করে।
দিনাজপুর ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. শাহ মোহাম্মদ শরীফ বলেন—সুস্থ মানুষকে অসুস্থ বানানো মানবিক অপরাধ। যক্ষা রোগ নির্ণয় কেন্দ্র বছরের পর বছর সরকারি ওষুধ লুকিয়ে রেখে অনিয়ম করছিল। বিপুল পরিমাণ ওষুধ উদ্ধার হয়েছে, ফ্রিজে জমাট কফও পাওয়া গেছে। আমরা বিষয়টি আরও তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেব।
দিনাজপুর প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম রঞ্জু বলেন, শেষ কথা—রোগ নয়, প্রতারণার ভাইরাস ছড়াচ্ছ। সরকারি স্বাস্থ্যসেবার নামে কীভাবে একটি চক্র মানুষের ভয়কে অস্ত্র বানিয়ে দুর্নীতির পথ তৈরি করেছিল। যক্ষ্মা রোগের ভয় নয়— এ চক্রের প্রতারণাই ছিল মানুষের জন্য বড় বিপদ।
প্রশাসনের দ্রুত পদক্ষেপে চক্রটি ধরা পড়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায়— আরও কত এলাকায় এমন নকল রোগী বানিয়ে ওষুধ লুট চলছে?
সমাজের জন্য এটি সতর্কতার ঘণ্টা—
মানুষের রোগ নয়, মানুষের বিশ্বাসই যেন সবচেয়ে বেশি অসুস্থ হয়ে না পড়ে।

