ভিনগ্রহে প্রাণের অস্তিত্বের বিষয়ে বিজ্ঞানীরা নতুন এক মোড় নিতে চলেছেন। সম্প্রতি নাসার জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ দিয়ে মহাকাশের এক দূরবর্তী গ্রহ, কে২–১৮বি-তে এমন একটি রাসায়নিক যৌগের উপস্থিতির ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, যা সাধারণত পৃথিবীতে জীবিত প্রাণী—বিশেষ করে সামুদ্রিক ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন ও ব্যাকটেরিয়ার দ্বারা উৎপন্ন হয়।
এটি ছিল এই টেলিস্কোপের মাধ্যমে দ্বিতীয়বারের মতো কোনো গ্রহে প্রাণ-সম্পৃক্ত অণুর সন্ধান। তবে এবার বিজ্ঞানীদের আশাবাদ অনেক বেশি। কারণ, গ্রহটির বায়ুমণ্ডলে যে ডাইমিথাইল সালফাইড (বা তার সমজাতীয় ডাইমিথাইল ডিজালফাইড) রয়েছে বলে প্রমাণ মিলেছে, তা পৃথিবীতে একমাত্র জীবিত প্রাণীর মাধ্যমেই তৈরি হয়।
গবেষণা দলের প্রধান, অধ্যাপক নিক্কু মধুসূদন বলেন,
“মহাবিশ্বে প্রাণের সম্ভাবনা নিয়ে এ যাবৎ আমরা যত আলামত পেয়েছি, তার মধ্যে এটি সবচেয়ে শক্তিশালী। যদি এই উপাত্তগুলো সত্য প্রমাণিত হয়, তাহলে এটি এক যুগান্তকারী আবিষ্কার হবে।”
কে২-১৮বি পৃথিবী থেকে প্রায় ১২৪ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত, যা প্রায় ৭০০ ট্রিলিয়ন মাইল দূরত্বে। গ্রহটি আয়তনে পৃথিবীর প্রায় আড়াই গুণ বড়। ধারণা করা হচ্ছে, এটি এমন একটি গ্রহ যার পৃষ্ঠে হাইড্রোজেন-সমৃদ্ধ বায়ুমণ্ডল রয়েছে এবং গভীরে তরল পানির সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন স্পেকট্রোস্কোপিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে গ্রহটির বায়ুমণ্ডলের উপাদান বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। অধ্যাপক মধুসূদন জানান, পৃথিবীতে যে পরিবেশে এই গ্যাস তৈরি হয়, সেই তুলনায় কে২-১৮বি-তে তার হাজারগুণ বেশি পরিমাণ গ্যাস রয়েছে—যা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
তবে বিজ্ঞানীদের কাজ এখানেই শেষ নয়। এই গ্যাস সত্যিই জীবনের উপস্থিতির ইঙ্গিত দেয় কি না, তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন আরও পরীক্ষানিরীক্ষা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা—যা বিজ্ঞানীরা ‘ফাইভ সিগমা’ রেজাল্ট নামে চিহ্নিত করেন। আপাতত তারা প্রায় ৯৯.৭ শতাংশ নিশ্চিত—যা থ্রি সিগমা হিসেবে বিবেচিত—কিন্তু চূড়ান্ত স্বীকৃতির জন্য দরকার ৯৯.৯৯ শতাংশ নিশ্চয়তা।
তাছাড়া, জীবনের মাধ্যমে উৎপন্ন এই গ্যাস অজৈব কোনো রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেও কি সৃষ্টি হতে পারে? এ প্রশ্নের উত্তরও বিজ্ঞানীদের খুঁজতে হচ্ছে। যদি দেখা যায়, প্রাণ ছাড়া অন্যভাবেও এই গ্যাস উৎপন্ন হতে পারে, তাহলে বর্তমান অনুমান ভুল প্রমাণিত হতে পারে।
এছাড়া কে২-১৮বি গ্রহটির প্রকৃতি নিয়েও মতবিরোধ রয়েছে—কারো মতে এটি তরল পানির বিশাল জলাধারবিশিষ্ট একটি গ্রহ, আবার কারো মতে এটি একটি গ্যাসীয় দৈত্য বা পাথুরে গ্রহও হতে পারে।
তবুও, অধ্যাপক মধুসূদনের কণ্ঠে আশার সুর—
“যদি কে২-১৮বি-তে জীবনের অস্তিত্ব নিশ্চিত হয়, তাহলে এটা প্রমাণ করবে যে প্রাণ সৃষ্টি কোনো বিরল ঘটনা নয়। সম্ভবত, মহাবিশ্বে আমরা একা নই।”
এই আবিষ্কার শুধু একটি গ্রহে প্রাণের সম্ভাবনার গল্প নয়, বরং এটি মানবজাতির দীর্ঘকালীন এক প্রশ্নের উত্তর খোঁজার পথে এক বড় পদক্ষেপ—“আমরা কি একা?”