নীলাভ সমুদ্রের ঢেউ যেন মৃদু ছোঁয়ায় আলতো করে আদর করে সাদা বালুকাবেলাকে। দূরে দিগন্তে জেগে আছে সবুজে মোড়া ছোট্ট এক স্বপ্নদ্বীপ সেন্টমার্টিন। প্রবালের রঙিন ছোঁয়া, কেয়াগাছের ঘন ছায়া আর নীল সমুদ্রের অনন্ত আহ্বানের মধ্যে এই দ্বীপে পর্যটকদের চোখে সবচেয়ে বেশি ধরা পড়ে এক অদ্ভুত সৌন্দর্য—সারি সারি নারিকেল গাছ। স্থানীয়দের কাছে এই দ্বীপ পরিচিত ‘নারিকেল জিনজিরা’ নামে। নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে প্রকৃতির সাজানো জীবন্ত কবিতা।
প্রতিবছর শীতের শুরুতেই যখন পর্যটন মৌসুমের ঘণ্টা বাজে, তখন দেশি-বিদেশি পর্যটকদের পা পড়ে এই প্রবাল দ্বীপে। সূর্যের আলো যখন পানির উপর প্রতিফলিত হয়, তখন নারিকেল পাতার ফাঁক দিয়ে বাতাসে দুলে ওঠে সবুজের ঢেউ। সেই মুহূর্তে যেন প্রকৃতি নিজেই তৈরি করে এক অনুপম চিত্রকর্ম, যেখানে নীল, সাদা আর সবুজের সুর মিশে যায় এক সঙ্গীতে। এই দৃশ্যের টানে প্রতিদিনই সেন্টমার্টিনে ছুটে আসেন হাজারো মানুষ, প্রকৃতিপ্রেমী ও ভ্রমণপিপাসুদের ভিড়ে মুখর হয়ে ওঠে দ্বীপের বালুকাবেলা।
তবে পর্যটন মৌসুম এখনো পুরোপুরি শুরু হয়নি। কক্সবাজারের অন্যান্য পর্যটনকেন্দ্রে ভিড় বাড়লেও সেন্টমার্টিন এখন অপেক্ষায়। প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, নভেম্বর থেকেই আবার পর্যটকদের যাতায়াত শুরু হবে। আর তখনই আবার জীবন্ত হয়ে উঠবে নারিকেল জিনজিরার পথঘাট, দোকানপাট, মানুষের মুখে মুখে ঘুরে বেড়াবে সমুদ্রের গল্প আর ডাবের মিষ্টি স্বাদ।
দ্বীপের বাসিন্দা তৈয়ব উল্লাহ বলেন, “আমাদের এই নারিকেল গাছ শুধু সৌন্দর্যের নয়, জীবিকারও অংশ। ডাব বিক্রি করেই অনেক পরিবার সংসার চালায়। আগে এত গাছ ছিল যে, এখানকার ডাব টেকনাফ, কক্সবাজার এমনকি চট্টগ্রাম পর্যন্ত যেত। এখন কিছু গাছ পোকামাকড় আর ঘূর্ণিঝড়ে নষ্ট হলেও আমরা নতুন করে রোপণ করছি।”
তার কথার সঙ্গে সুর মিলিয়ে সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ফয়েজুল ইসলাম বলেন, “একসময় এই দ্বীপ সত্যিকারের নারিকেল জিনজিরা ছিল। থরে থরে ডাবে পূর্ণ থাকত চারপাশের নারিকেল গাছ। কিন্তু কয়েক বছর ধরে সাদা মাছির আক্রমণে অনেক গাছ মারা গেছে। এখন বেশিরভাগ গাছেই ফলন কমে গেছে।”
তবুও হার মানেননি দ্বীপবাসী। খালি জায়গায় আবার রোপণ করা হচ্ছে নারিকেল চারা এবং যত্ন নেওয়া হচ্ছে বাকি গাছগুলোর। তারা জানান, এই নারিকেল গাছ কেবল প্রকৃতির অলংকার নয়, এ দ্বীপের অস্তিত্বেরও প্রতীক।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ এহেসান উদ্দিন বলেন, “বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ হিসেবে সেন্টমার্টিনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অতুলনীয়। আমরা চাই এই সৌন্দর্য যেন টিকে থাকে। পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের টেকসই জীবিকা নিশ্চিত করতে প্রশাসন কাজ করছে। নারিকেল গাছে পোকামাকড় রোধেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।”
নীল আকাশের নিচে সাদা বালুকাবেলায় দাঁড়িয়ে যখন বাতাসে দুলে ওঠে নারিকেল পাতাগুলো, তখন মনে হয়, এই দ্বীপ যেন প্রকৃতির ক্যানভাসে আঁকা এক অপূর্ণ কবিতা। প্রবালের রঙ, সমুদ্রের ঢেউ, আর নারিকেল জিনজিরার সবুজ ছায়া; সব মিলিয়ে সেন্টমার্টিন আজও থেকে গেছে বাংলাদেশের প্রকৃতি আর মানুষের জীবনের গল্প জড়িয়ে আছে এক অদ্ভুত মায়ার বন্ধনে।