সত্যজিৎ দাস:
একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে হাজার হাজার বছরের ইতিহাসের সাক্ষী ” ত্রিপুরা “। আজ তা ভারতের একটি সীমান্তবর্তী রাজ্য, অথচ একসময় ছিল উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও নিরবিচারে হিন্দু রাজশক্তির প্রতীক। প্রশ্ন উঠছে যে,ঐতিহ্য,ধর্ম ও শাসনব্যবস্থায় অটুট এই হিন্দু রাজ্য কীভাবে ভাসানীর রাজনীতির নামে এক নতুন ব্যাখ্যার শিকার হলো?
ত্রিপুরা নামের শিকড় খুঁজলে তা গিয়ে ঠেকে পৌরাণিক যুগে। মহাভারতের আদিপর্ব, ভাগবত পুরাণ এবং বিভিন্ন স্মৃতিশাস্ত্রে “ত্রিপুরা” নামটি এসেছে। ইতিহাসবিদদের মতে,এই নামের উৎস ‘ত্রিপুরাসুর’ থেকে, যাকে বধ করেছিলেন স্বয়ং মহাদেব। এভাবেই শৈব ও বৈষ্ণব ধর্মের এক সহাবস্থান তৈরি হয়েছিল ত্রিপুরায়।
ত্রিপুরার সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ও গৌরবময় রাজবংশ হচ্ছে চন্দ্রবংশীয় মাণিক্য বংশ। প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন রাজতালিকায় এই বংশের উপস্থিতি দৃঢ়।
ত্রিপুরার ইতিহাসে পাওয়া যায় ১৮৪ জন রাজা ও উপরাজা’র নাম; যা ইতিহাসে একটি বিরল দৃষ্টান্ত।
তাদের অনেকেই ছিলেন সংস্কৃত শিক্ষায় শিক্ষিত, ধর্মীয় শাস্ত্রজ্ঞ এবং সামাজিক সংস্কারক।
রাজা গোবিন্দ মাণিক্য,রাজা রাধাকিশোর মাণিক্য বা রাজা বীর বিক্রম কিশোর মাণিক্যের মতো শাসকেরা শুধুমাত্র প্রশাসক ছিলেন না। তারা ছিলেন একাধারে ভক্ত,সংস্কৃতির ধারক এবং ধর্মীয় পরিচয়ের রক্ষক। ত্রিপুরার শত শত মন্দির,আশ্রম ও বেদপাঠশালার পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন তাঁরা।
স্বাধীনতা-উত্তর উপমহাদেশে যখন রাজ্য পুনর্গঠন চলছিল,ত্রিপুরাও সেই ঢেউয়ের বাইরে ছিল না।
১৯৪৯ সালে রাজা বীর বিক্রম কিশোর মাণিক্যের মৃত্যুর পর ভারত সরকার ‘মার্জার এগ্রিমেন্ট’-এর মাধ্যমে রাজ্যটিকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করে।
এই পর্যায়ে,কিছু রাজনৈতিক মহল ত্রিপুরার ইতিহাসকে সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাখ্যায় উপস্থাপন করতে শুরু করে। গণতান্ত্রিক উদারপন্থা এবং কৃষকনির্ভর রাজনীতির পটভূমিতে উত্থাপিত হয় ‘ভাসানীর ত্রিপুরা’ নামক এক রাজনৈতিক তত্ত্ব,যা আদতে ছিল পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের প্রগতিশীল আন্দোলনের প্রতিফলন।
একটি প্রাচীন হিন্দু রাজ্য,যার রক্তে মহাভারতের উত্তরাধিকার,যার সংস্কৃতিতে শিব,বিষ্ণু ও দুর্গার আরাধনা,যার প্রশাসনবোধ শাস্ত্রনির্ভর,তা কিভাবে হয়ে গেল একদল রাজনৈতিক দর্শনের প্রতীক?
ত্রিপুরার ইতিহাস নিছক ভারত বা বাংলাদেশ সীমিত অঞ্চলের নয়। এটি উপমহাদেশীয় হিন্দু রাজনৈতিক,সাংস্কৃতিক এবং আধ্যাত্মিক ইতিহাসের একটি অমূল্য অধ্যায়। ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের মতে,“ত্রিপুরা ছিল একমাত্র রাজ্য,যা পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত একটি কার্যকর হিন্দু রাজনীতিক কাঠামো ধরে রেখেছিল।”
এই রাজ্য আজ আন্তর্জাতিক গবেষণার জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হতে পারে। বিশ্ববাসীর সামনে ত্রিপুরাকে তুলে ধরতে হলে প্রয়োজন নতুন ব্যাখ্যা নয়,বরং তার প্রকৃত ইতিহাসকে পুনরুদ্ধার।
ত্রিপুরা ভাসানীর ছিল না। ত্রিপুরা ছিল ধর্মাধিষ্ঠিত রাজনীতি,শাস্ত্রবহাল প্রশাসন ও সংস্কৃতিবান শাসকদের ইতিহাস। এই ইতিহাস শুধু স্মরণ করার নয়,লেখার,ছড়িয়ে দেওয়ার- আন্তর্জাতিক পাঠকের কাছেও।
বিঃদ্রঃ-এই প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে ঐতিহাসিক দলিল,পুরাতন রাজতালিকা,বিভিন্ন গবেষণা প্রবন্ধ এবং ত্রিপুরার আদি রাজার রাজস্ব নথি পর্যালোচনা করা হয়েছে।