হাবিব আহমেদ,রাজশাহী:
নানা অনিয়মের মধ্যে চলছে রাজশাহীর শাহমখদুম কলেজ। শাহমখদুম কলেজের পাশাপাশি শিক্ষকরা বিধি বহির্ভতভাবে করছেন বাইরে চাকরি। কোনো শিক্ষক অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, কেউ প্রাইভেট কোম্পানীতে আবার কেউ এনজিওতে চাকরি করছেন। এ কলেজের এক শিক্ষক দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ নিয়েও চাকরি করছেন।
সাক্ষর করছেন দুই প্রতিষ্ঠানেরই হাজিরা খাতায়। শুধু তাই নয়, পরীক্ষার উত্তরপত্র জালিয়াতির ঘটনায় বরখাস্ত ও বিভাগীয় মামলা হওয়া শিক্ষকও তুলছেন পুরো বেতনভাতা। সব মিলিয়ে রাজশাহী শাহমখদুম কলেজ যেনো অনিয়ন, দুর্নীতির আখড়া। এসব অনিয়ম দেখেও না দেখার ভান করছেন কলেজের অধ্যক্ষ। অভিযোগ রয়েছে, খোদ কলেজের অধ্যক্ষ নিজেই এসব অনিয়মের আশ্রয়-প্রশ্রয় দাতা। অধ্যক্ষ এসব কর্মকাণ্ড প্রশ্রয় দিয়ে ফায়দা লুটছেন। আর এসব বিষয়ে কলেজের অধ্যক্ষ বলছেন, তিনি কিছুটা জানেন, আবার বলছেন, কিছুটা জানি না। অথচ অধ্যক্ষের সামনেই হচ্ছে এসব অনিয়ম। তারপরও তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। তবে সংশ্লিষ্টদের ভাষায়, অনিয়মকে নিয়ম করেই চলছে রাজশাহী শাহমখদুম কলেজের কার্যক্রম।
জানা গেছে, রাজশাহীর শাহমখদুম কলেজের অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক জজম আলী। তিনি সাবেক সদর আসনের এমপি ফজলে হোসেন বাদশার সুপারিশে গত ২০১৭ সালের দিকে শাহমখদুম কলেজে প্রভাষক পদে (৩য়) নিয়োগ পেয়েছেন। কিন্তু এই প্রভাষক চাঁপাইনবাবগঞ্জের শরৎনগর দাখিল মাদ্রাসার সামাজ বিজ্ঞানের শিক্ষক। এই মাদ্রাসায় তার ইনডেক্স রয়েছে (যার নম্বর-২০২৩৬৫০)। প্রভাষক জজম আলী শরৎনগর দাখিল মাদ্রাসা থেকে বেতনভাতা নিচ্ছেন। সেখানে করছেন ক্লাস। নিয়মিত হাজিরা খাতাও সাক্ষর করছেন। আবার শাহমখদুম কলেজেও তিনি নিয়মিত আসা যাওয়া করছেন, নিয়মিত রয়েছে হাজিরা খাতায় সাক্ষর। শাহমখদুম কলেজ থেকে তাকে কোনো বেতনভাতা দেয়া হয় না। তারপরও তিনি এই কলেজেও নিয়মিত। এখন প্রশ্ন উঠেছে একজন শিক্ষক দুটি প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত কিভাবে সম্ভব?।
রাজশাহীর শাহমখদুম কলেজের সহকারী অধ্যাপক মিজানুর রহমান। তিনি মুলত ইসলামের ইতিহাস ও সাংস্কৃতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসাবে রয়েছেন। তিনি শাহমখদুম কলেজে চাকরি করলেও তার পাশাপাশি বেসরকারী রাঙ্গাপরি কোম্পানীতে চাকরি করেন। নিয়মিত কলেজে যাওয়ার নজির না থাকলেও রাঙ্গাপরি কোম্পানীতে যাওয়া বাদ নেই। মিজানুর রহমান শাহমখদুম কলেজের চেয়ে বেশি সময় দেন প্রাইভেট কোম্পানীতে। যদিও তিনি তথ্য গোপন করে প্রাইভেট কোম্পানরীতে চাকরি করছেন। কলেজের অধ্যক্ষসহ অন্য শিক্ষকরা জানেন সহকারী অধ্যাপক মিজানুর রহমান বাইরে চাকরি করেন না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তিনি রাঙ্গাপরি কোম্পানীর নিয়মিত একজন কর্মচারি।
শাহমখদুম কলেজের ম্যানেজমেন্ট (অনার্স) বিভাগের শিক্ষক নাজিম উদ্দিন। তিনি এই কলেজে চাকরির পাশাপাশি রাজশাহীর আলুপট্টি শাখার ব্যাক ব্যাংকে চাকরি করেন। পান মোটা অংকের বেতন। তিনি দুটি চাকরিতেই সময় দিচ্ছেন। কলেজ থেকেও বেতন ভাতা পাচ্ছেন আবার ব্যাক ব্যাংক থেকেও বেতনভাতা তুলছেন। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে তিনি কোন বিধির বলে দুই জায়গায় চাকরি করছেন। আর এ শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষার্থীরাই বা কতটুকু শিক্ষা লাভ করছেন।
শাহমখদুম কলেজের অপর প্রভাষক মাসুদুল হাসান। পুরো কলেজের শিক্ষকদের মধ্যে একটি বিতর্কিত নাম। ২০১৭ সালের ২২ মে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) মন্নুজান হল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ১০০টি উত্তরপত্র উদ্ধার হয়।
এসব উত্তরপত্র কেলেঙ্কারী ঘটনায় জড়িত ছিলেন প্রভাষক মাসুদুল হাসান। উত্তরপত্র উদ্ধারের পর তদন্তে উঠে আসে খাতাগুলো দেওয়া হয়েছিল নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক ড. আবুল কালামকে। তিনি উত্তরপত্র মূল্যায়নের জন্য দেন শাহমখদুম কলেজের প্রভাষক মাসুদুল হাসানকে। মাসুদুল খাতাগুলো মূল্যায়ন করতে দেন তার কোচিংয়ের ছাত্র রাবির বাংলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রকে। ওই ছাত্র আবার তার এক বান্ধবীর কাছে ওই খাতা দেন মূল্যায়নের জন্য। পরে রাবির মন্নুজান হল থেকে উত্তরপত্রগুলো উদ্ধার হয়। এ ঘটনায় প্রভাষক মাসুদুল হাসানের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। শিক্ষামন্ত্রণালয় থেকে তাকে বরখাস্ত করার জন্য নিদের্শ দেয়া হয়। পরে কলেজ থেকে তাকে বরখাস্তও করা হয়। মূলত একজন শিক্ষককে বরখাস্ত করা হলে তিনি বেতনের অর্ধেক টাকা পাবেন। কিন্তু মাসুদুল হাসান বেতনের অর্ধেক টাকা না তুলে পুরো টাকাই তুলছেন। যে বিষয়টি কলেজের অধ্যক্ষ জানলেও কোনো ব্যবস্থা নেননি।
বাংলা বিভাগের শিক্ষক ড. হাসান ফরিদ। নিয়োগের সময় তার কোনো নিবন্ধন সনদপত্র ছিল না। ২০১৫ সালে কলেজের অডিটে এই শিক্ষকের নিবন্ধন না থাকার বিষয়টি ধরা পড়ে। এমন কি অডিটের সময় তার নিবন্ধন সনদ দেখাতে পারেনি কলেজ কর্তৃপক্ষ। পরে অডিট রিপোর্টে তার নিয়োগ স্বচ্ছ নয় বলে রিপোর্ট দেয়া হয়। কিন্তু ১০ বছর পর সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রণালয়ের অডিটে ড. হাসান ফরিদের নিবন্ধন দেখানো হয়েছে। কোথায় থেকে এলো এই নিবন্ধন সনদপত্র এ নিয়ে নানান প্রশ্নের জন্ম হয়েছে।
জানা যায়, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা অনুযায়ী বলা আছে, একজন শিক্ষক একই সঙ্গে একাধিক পদে বা লাভজনক কোনো পদে থাকতে পারবেন না। কিন্তু শাহমখদুম কলেজের অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক জজম আলী, সহকারী অধ্যাপক মিজানুর রহমান, ম্যানেজমেন্ট (অনার্স) বিভাগের শিক্ষক নাজিম উদ্দিন এমপিও নীতিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চাকরি করছেন। তবে দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করার বিধি বিধান রয়েছে, এমনটা দাবি করেছেন প্রভাষক জজম আলী। তিনি বলেন, নীতিমালা আছে বলেই আমি চাকরি করছি।
একই ব্যক্তি দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ নিয়ে চাকরি করতে পারবে না জানিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শরৎনগর মাদ্রাসার সুপার আব্দুল মালেক বলেন, শুনেছি জজম আলী রাজশাহী শাহমখদুম কলেজে নিয়োগ পেয়েছেন। তবে তার এই নিয়োগ বৈধ নয়। একজন শিক্ষক কখনোই দুটি নিয়োগ নিয়ে দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে পারবেন না। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালায় এমন কোনো ধারা বা উপ-ধারা নেই।
এদিকে, তিন শিক্ষকের বিধি বর্হিভুতভাবে বাইরে চাকরি, বরখাস্ত হওয়ার পরও পুরো বেতনভাতা উত্তোলনের বিষয়টি শাহমুখদুম কলেজের অধ্যক্ষ এসএম রেজাউল ইসলাম জানেন। এমন কি সম্প্রতি প্রভাষক জজম আলীর প্রভাষক পদটি এমপিও করার জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা রাজশাহী আঞ্চল (মাউশি) অফিসে কাগজপত্র জমা দিয়েছেন অধ্যক্ষ। সেখানে ২০১৭ সালে নিয়োগপ্রাপ্ত ৩য় শিক্ষকের তালিকা পাঠানো হয়েছে। কিন্তু অধ্যক্ষ বলছেন, ৩য় শিক্ষকের বিষয়টি তিনি গুরুত্ব দেন না। আর বাইরে চাকরির বিষয়টিও তিনি আংশিক জানেন বলে দাবি করেন।
শাহমুখদুম কলেজের অধ্যক্ষ এসএম রেজাউল ইসলাম বলেন, প্রভাষক জজম আলী শাহমখদুম কলেজে নিয়োগ পেলেও এখান থেকে তাকে বেতনভাতা দেয়া হয় না। একজন শিক্ষক দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে পারবেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়টি আমার জানা নেই। তিনি বলেন, আমি শুনেছি শিক্ষক মিজানুর রহমান ও নাজিম উদ্দিন বাইরে চাকরি করেন। তবে এটাও শুনেছি তারা চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। প্রভাষক মাসুদুল হাসানের বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, দুএক মাস হয়তো পুরো বেতন তুলেছেন। তবে খোঁজ নিয়ে দেখবো, যেনো আর পুরো বেতনভাতাদি তুলতে না পারেন। মুলত অধ্যক্ষ সব জানার পরও শুনেছি, জেনেছি বা না জানার ভান করে বিষয়টিগুলো এড়িয়ে যান।
এব্যাপারে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা রাজশাহী অঞ্চলের (মাউশি) পরিচালক প্রফেসর মোহা. আছাদুজ্জামান বলেন, কোনো শিক্ষক দুই প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ নিয়ে দুটিতেই চাকরি করলে সেটা ফোজদারি অপরাধ। এমন কি বাইরে কোনো কোম্পানীতে চাকরি করলেও একই অপরাধে অপরাধি তিনি। ইনডেক্সধারী শিক্ষক দুটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে পারবেন না। তিনি বলেন এসব বিষয় কলেজের অধ্যক্ষ বা গভর্নিংবডির সদস্যদের দেখার কথা। কিন্তু তারা দেখেন না। কলেজের অধ্যক্ষ বা গভর্নিংবডির সদস্যদের যোগসাজসেই মূলত এধরনের অনিয়মের ঘটনাগুলো ঘটে। তিনি শাহমখদুম কলেজের বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন বলেও জানান।