ফারাক্কার বাঁধের প্রভাব: বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পরিবেশগত বিপর্যয়
ফারাক্কার বাঁধের নির্মাণ বাংলাদেশের নদী-জলসম্পদ এবং কৃষি পরিবেশে যে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে, তা কেবল একটি দেশীয় সমস্যা নয়, বরং একটি আন্তর্জাতিক পরিবেশগত সংকট হিসেবে উঠে এসেছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুর্শিদাবাদে অবস্থিত এই বাঁধ ১৯৭৫ সালে নির্মিত হয় এবং তার পর থেকে বাংলাদেশের জন্য এটি এক গভীর পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাঁধের প্রভাবে, বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে নদ-নদীর পানি প্রবাহে সীমিততা সৃষ্টি হয়েছে, যার ফলে কৃষি, পরিবেশ এবং জীবনযাত্রার অন্যান্য দিকগুলোতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
ফারাক্কার বাঁধের কার্যক্রম এবং প্রভাব
ফারাক্কার বাঁধ নির্মাণের পর থেকেই বাংলাদেশের বিভিন্ন নদী যেমন গঙ্গা, পদ্মা, মেঘনা, গৌরী, কালিনগর, এবং ছোট-বড় আরও অনেক নদীর জল প্রবাহের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। বাঁধটির মাধ্যমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কৃষি ও শিল্পের জন্য পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা হলেও, এর ফলে বাংলাদেশের বৃহৎ নদ-নদী অববাহিকার ওপর অপ্রত্যাশিতভাবে পানির প্রবাহ কমে গেছে, যা কৃষি উৎপাদন, পরিবেশ ও বায়ু গুণগত মানের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
ফারাক্কার বাঁধের কারণে নদীগুলির পানির প্রবাহের সাভাবিকতা বিঘ্নিত হওয়ায় বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চরম ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে, এই অঞ্চলের পানির সরবরাহ কমে যাওয়ার ফলে কৃষকরা প্রতিবছর বৃষ্টির জন্য নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। একইসঙ্গে, নদী থেকে মাছ সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে, যা মাছচাষী এবং উপকূলীয় সম্প্রদায়ের জন্য এক বিরাট সমস্যা।
কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা:
বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল কৃষিপ্রধান এলাকা। ফারাক্কার বাঁধের কারণে এই অঞ্চলে পানি সংকটের কারণে কৃষি উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নদীগুলির পানির প্রবাহ কমে যাওয়ার ফলে নদীভাঙন, জলাবদ্ধতা, এবং মরুকরণ ত্বরান্বিত হচ্ছে, যা কৃষকের আয় এবং খাদ্য নিরাপত্তা চরম হুমকির মুখে ফেলেছে।
বিশেষত, ‘পদ্মা’ এবং ‘যমুনা’ নদীর জলপ্রবাহ কমে যাওয়ায় ঐ অঞ্চলে ধান, গম, ভুট্টা ও অন্যান্য কৃষিপণ্য চাষে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলস্বরূপ, কৃষকরা স্বাভাবিকভাবেই তাদের পণ্য উৎপাদন করতে পারছেন না, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
পরিবেশগত বিপর্যয় এবং জীববৈচিত্র্য:
ফারাক্কার বাঁধের অন্যতম বড় প্রভাব হল, নদ-নদীর জলস্তর হ্রাস পাওয়া। এর ফলে, নদী-জলাভূমি ও এর পারিপার্শ্বিক এলাকায় বাস করা অনেক প্রজাতির উদ্ভিদ এবং প্রাণী, বিশেষ করে মাছের প্রজাতি, হারিয়ে যেতে শুরু করেছে। নদী পরিবেশের পরিবর্তন এবং জলস্তরের হ্রাসের কারণে প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি হচ্ছে, যা প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের জন্য বড় ধরনের বিপদ।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকা যেমন সুন্দরবন, যেখানে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল রয়েছে, সেখানে এর প্রভাব স্পষ্ট। ফারাক্কার বাঁধের কারণে নদীর পানির প্রবাহ কমে যাওয়ার ফলে উপকূলীয় জলাবদ্ধতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা এই অঞ্চলের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যকে ধ্বংস করতে শুরু করেছে। সুন্দরবন অঞ্চলের ম্যানগ্রোভ বনের স্থায়িত্ব হুমকির মুখে পড়ছে এবং সেখানে জলজ প্রাণীদের জীবনযাত্রা ক্রমেই দুর্বিষহ হয়ে উঠছে।
ফারাক্কার বাঁধের পানি শোষণের প্রক্রিয়ার কারণে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে মরুকরণের প্রবণতা বেড়েছে। এই অঞ্চলের বিশাল অংশ মরুকরণের শিকার হচ্ছে এবং কৃষি জমি দিন দিন অনুর্বর হয়ে পড়ছে। নদীর পানি কমে যাওয়ায় জমির আর্দ্রতা হ্রাস পাচ্ছে, ফলে কৃষি জমি শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে মরুকরণ রোধে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হলেও, ফারাক্কার বাঁধের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব মোকাবেলা করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও সমাধান:
ফারাক্কার বাঁধের ফলে সৃষ্টি হওয়া সমস্যা শুধু বাংলাদেশই নয়, ভারতের জন্যও একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পানি সংকট, কৃষি সমস্যা এবং পরিবেশগত বিপর্যয়গুলো দুই দেশের জন্যই মারাত্মক হতে পারে। তবে এই সমস্যা সমাধানের জন্য বাংলাদেশ এবং ভারতকে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ফোরামে বার বার এই বিষয়ে আলোচনা করেছে, বিশেষ করে গঙ্গা ও পদ্মা নদীর পানি প্রবাহের স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনার জন্য ভারতের সঙ্গে সমঝোতা চেয়েছে। ১৯৯৬ সালে গঙ্গা পানি চুক্তি হলেও ফারাক্কার বাঁধের কারণে এর কার্যকারিতা সীমিত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন, নদী দূষণ, এবং পানির অব্যবস্থাপনা বাংলাদেশের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পরবর্তী সময়ের জন্য, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সম্মিলিতভাবে এই সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হতে হবে। ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে শক্তিশালী পানি ব্যবস্থাপনা চুক্তি এবং উপযুক্ত পরিবেশগত সমঝোতার মাধ্যমে পরিবেশগত বিপর্যয়ের লাগাম টানা সম্ভব হতে পারে।