২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসে এক রক্তাক্ত, হৃদয়বিদারক অধ্যায়। দেশের সর্বস্তরের ছাত্র, যুবক, পেশাজীবী ও নাগরিক সমাজ এক বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শামিল হয়, যা পরিণত হয় এক গণ-অভ্যুত্থানে। তবে এই ঐতিহাসিক গণজাগরণ যেমন দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক পরিবর্তনের সূচনা করে, তেমনই রেখে যায় শত শত শহীদের রক্তাক্ত স্মৃতি।
তবে প্রশ্ন একটাই — আসলে কতজন শহীদ হয়েছিলেন জুলাই অভ্যুত্থানে?
এই প্রশ্নের উত্তর একরৈখিক নয়। সরকারি গেজেট, জাতিসংঘের তদন্ত রিপোর্ট, আন্দোলনকারী সংগঠনের হিসাব, রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্য এবং বেসরকারি পর্যবেক্ষক সংস্থার তথ্য—সব মিলিয়ে একটি পরস্পরবিরোধী চিত্র তৈরি হয়েছে।
🔷 সরকারি হিসাব: ৮৩৪ জন
২০২৫ সালের ১৫ জানুয়ারি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে একটি সরকারি গেজেট প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, ৮৩৪ জন শহীদকে “জুলাই শহীদ” হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এদের পরিচয় ও মৃত্যুপরিস্থিতি যাচাই করে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
সরকার বলছে, এখনো আরও বহু নাম যাচাই-বাছাইয়ের প্রক্রিয়ায় রয়েছে এবং পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরিতে কাজ চলছে। তবে এটিই এখন পর্যন্ত একমাত্র রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত তালিকা।
🔷 জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের দাবি: ৮২০+
বেসরকারি সংস্থা জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন তাদের ওয়েবসাইটে সর্বশেষ (৪ মে ২০২৫) তথ্য অনুযায়ী শহীদের সংখ্যা ৮২০ জনের বেশি বলে জানিয়েছে। আশ্চর্যের বিষয়, তাদের হিসাব সরকারি গেজেটের চেয়েও কম। তবে তারা স্পষ্ট করে বলেছে, তথ্য সংগ্রহ চলমান এবং নিশ্চিত তথ্য না পেলে তালিকায় নাম তোলা হচ্ছে না।
🔷 জাতিসংঘের প্রতিবেদন: ১,৪০০+ জন
জাতিসংঘের মানবাধিকার হাই কমিশনারের কার্যালয় (OHCHR) ২০২৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারিতে একটি বিস্তৃত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়:
“১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট ২০২৪ সালের মধ্যে ১,৪০০ জনের বেশি মানুষ হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে। এদের মধ্যে ১২–১৩ শতাংশ শিশু। আহত হয়েছেন কয়েক হাজার।”
এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, নিহতদের মধ্যে রয়েছে:
- নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিহত সাধারণ আন্দোলনকারী
- সরকারপন্থী ও বিরোধী দলের সংঘর্ষে নিহত ব্যক্তি
- পুলিশ বাহিনীর সদস্য (৪৪ জন)
- আওয়ামী লীগের পক্ষে থাকা কর্মী (১৪৪ জন)
তবে জাতিসংঘ স্পষ্ট করে জানায়, সব মৃত্যুর ঘটনা স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি, এবং ফৌজদারি তদন্ত প্রয়োজন।
🔷 আন্দোলনকারী সংগঠনের দাবি: ১,৫৮১ জন
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, যারা প্রথম জুলাই অভ্যুত্থানের ডাক দেয়, তারা ২০২৪ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করে, শহীদের সংখ্যা ১,৫৮১ জন। যদিও তারা স্পষ্ট করে জানায়, এ সংখ্যা চূড়ান্ত নয়, এবং আরও তথ্য সংগ্রহের প্রক্রিয়া চলছে
🔷 রাজনৈতিক বক্তব্যের অসঙ্গতি
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর নেতারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সংখ্যা বলেছেন:
- হাসনাত আব্দুল্লাহ: “১৪শরও বেশি শহীদ”
- সারজিস আলম: “হাজারের অধিক”
এদের বক্তব্যে জাতিসংঘের রিপোর্টকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা হলেও একরকম স্থির সংখ্যা উঠে আসছে না।
🔷 বিশ্লেষকদের প্রতিক্রিয়া
সিনিয়র সাংবাদিক মাসুদ কামাল এই বিষয়ে বলেন:
“সরকারি ব্যর্থতার ফলে এখন শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি চলছে। যে আন্দোলনে এত মানুষ জীবন দিয়েছেন, তাদের সংখ্যা নির্ধারণে এই অনিশ্চয়তা অত্যন্ত লজ্জার।”
তিনি আরও বলেন, “আন্দোলনের সুফল যাঁরা ভোগ করছেন, তাঁদের অধিকাংশেরই এই আন্দোলনের সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। এ এক অপমানজনক বাস্তবতা।”
📌 উপসংহার: তাহলে প্রকৃত সংখ্যা কত?
উৎস | শহীদের সংখ্যা |
---|---|
সরকার | ৮৩৪ |
শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন | ৮২০+ |
জাতিসংঘ | ১,৪০০+ |
আন্দোলনকারী সংগঠন | ১,৫৮১ |
এনসিপি নেতারা | ১,০০০–১,৪০০+ |
🔎 স্পষ্টতই, এখনো নির্ভরযোগ্য, পূর্ণাঙ্গ ও চূড়ান্ত শহীদ তালিকা প্রকাশ হয়নি।
✍️ শেষ কথা
জুলাই অভ্যুত্থান শুধু একটি আন্দোলন ছিল না — এটি ছিল আত্মত্যাগ, ন্যায়বিচার এবং গণতন্ত্রের জন্য এক শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া। শহীদদের সংখ্যা শুধু একটি পরিসংখ্যান নয়, এটি একটি জাতির আত্মপরিচয়ের অংশ। সঠিক তালিকা তৈরি না হলে শুধু ইতিহাস বিকৃত হবে না, বরং শহীদদের প্রতি দায়ও অপূর্ণ থেকে যাবে।
📢 এখন সময় এসেছে—আবেগ নয়, তথ্য ও সততার ভিত্তিতে একটি স্বচ্ছ, নির্ভরযোগ্য এবং ঐকমত্যভিত্তিক শহীদ তালিকা প্রকাশ করার।