সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে কেন্দ্র করে যে মন্তব্য করেছেন, তা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ট্রাম্প অভিযোগ করেছেন যে জেলেনস্কি একটি প্রস্তাবিত শান্তিচুক্তি প্রত্যাখ্যান করে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে অপ্রয়োজনীয়ভাবে দীর্ঘায়িত করছেন। তার মতে, এই চুক্তি যুদ্ধের অবসান ঘটাতে পারত যদি ইউক্রেন কিছু “বাস্তববাদী” ছাড় দিত, যার মধ্যে ছিল রাশিয়ার দখলে থাকা ক্রিমিয়াকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং বর্তমান ফ্রন্টলাইনে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা।
এই অবস্থান ট্রাম্পের প্রশাসনের একটি দীর্ঘমেয়াদী কৌশলের প্রতিফলন, যার মূল লক্ষ্য হল ইউক্রেন যুদ্ধকে এমনভাবে নিষ্পত্তি করা যাতে যুক্তরাষ্ট্রকে সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে আর ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত হতে না হয়। ট্রাম্প স্পষ্ট করে বলেন, “ক্রিমিয়া ২০১৪ সালে রাশিয়ার হাতে চলে গেছে। ইউক্রেন তখন কিছুই করেনি। এখন সেটি ফেরত চাওয়া বাস্তবসম্মত নয়।” তিনি আরও বলেন, “জেলেনস্কি শান্তির পথে বাধা দিচ্ছেন। আমরা আর এই যুদ্ধের বোঝা বইতে পারি না।”
ট্রাম্পের এই বক্তব্য এবং প্রস্তাবিত শান্তিচুক্তির খসড়া অনুযায়ী, ইউক্রেনকে তার ভূখণ্ডের কিছু অংশ—বিশেষ করে ক্রিমিয়া ও পূর্বাঞ্চলীয় কিছু অঞ্চল—রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে রেখে দিতে হবে এবং তার ন্যাটোতে যোগদানের আকাঙ্ক্ষা থেকে সরে আসতে হবে। এমন একটি ব্যবস্থা ইউক্রেনের জন্য কৌশলগত ও সংবিধানিকভাবে অগ্রহণযোগ্য বলে প্রতীয়মান হয়েছে।
জেলেনস্কি এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন। তিনি বারবার বলেছেন যে ইউক্রেন কোনোভাবেই তার ভূখণ্ডের ওপর রাশিয়ার দখল মেনে নেবে না এবং যুদ্ধ শেষ হওয়ার জন্য তার দেশের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার ওপর কোনো আপস হবে না। তার মতে, শান্তি শুধুমাত্র তখনই সম্ভব যখন রাশিয়া তার দখলকৃত অঞ্চলগুলো থেকে সম্পূর্ণভাবে পিছু হটবে। জেলেনস্কি বলেন, “আমরা আমাদের ভূমি ছাড়তে পারি না। এটা আমাদের ইতিহাস, আমাদের অধিকার। কেউ জোর করে আমাদের কিছু চাপিয়ে দিতে পারবে না।”
এই টানাপোড়েনের মধ্যে, হোয়াইট হাউসের অভ্যন্তরে উত্তেজনা আরও বেড়ে যায় যখন ট্রাম্প ও জেলেনস্কির মধ্যকার একটি নির্ধারিত বৈঠক বাতিল হয়ে যায়। সূত্রমতে, Oval Office-এ একটি আলোচনার সময় ট্রাম্প জেলেনস্কিকে “যুক্তরাষ্ট্রকে অসম্মান করার” অভিযোগে তিরস্কার করেন এবং বলেন, “আপনি শান্তির জন্য প্রস্তুত নন।”
যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সও এই প্রসঙ্গে বক্তব্য দেন এবং স্পষ্ট বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র আর বেশি দিন ইউক্রেনের অবস্থানকে সমর্থন করে যাবে না যদি তারা এই প্রস্তাবিত শান্তিচুক্তিকে গ্রহণ না করে। তার মতে, “আমরা যদি অবিরাম যুদ্ধ দেখতে না চাই, তবে সীমান্ত যেখানে আছে সেখানেই থেমে যেতে হবে। কিছু ছাড় দিতেই হবে।” ভ্যান্সের এই মন্তব্য ইউক্রেনের জনগণের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে।
ইউক্রেনের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত তীব্র হয়েছে। অনেক ইউক্রেনীয় নাগরিক এবং আইনপ্রণেতা ট্রাম্পের প্রস্তাবিত শান্তিচুক্তিকে “ন্যায়বিচারের প্রতি অবজ্ঞা” হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। সংসদের একাধিক সদস্য বলেছেন, এ ধরনের চুক্তি রাশিয়াকে পুরস্কৃত করবে এবং এটি ইউক্রেনের দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলবে।
অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্পের বক্তব্য কেবল রাশিয়াকে কৌশলগত সুবিধা দিচ্ছে না, বরং এটি পশ্চিমা জোটের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টির সম্ভাবনাও তৈরি করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বহু সদস্য রাষ্ট্র, বিশেষ করে পোল্যান্ড এবং বাল্টিক দেশগুলো, ট্রাম্পের অবস্থান নিয়ে উদ্বিগ্ন। তারা মনে করছে, যদি যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেন থেকে তার সমর্থন প্রত্যাহার করে, তবে রাশিয়ার আগ্রাসন আরও বাড়বে।
এই প্রেক্ষাপটে, ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী ও নাগরিক সমাজ নতুন উদ্যমে রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। সাম্প্রতিক রাশিয়ান ড্রোন হামলায় বেসামরিকদের প্রাণহানির পর, ইউক্রেনীয় জনগণের মধ্যে প্রতিরোধের মনোভাব আরও দৃঢ় হয়েছে। অনেকেই বিশ্বাস করেন, এই যুদ্ধ শুধু ভূখণ্ড রক্ষার নয়, এটি জাতীয় পরিচয় ও স্বাধীনতার লড়াই।
বর্তমান পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সমীকরণ আরও জটিল হয়ে উঠছে। ট্রাম্পের অবস্থান আগামী মার্কিন নির্বাচনেও বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে, বিশেষ করে যদি তিনি আবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে র্যাডিকাল পরিবর্তন আনেন। অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, এই পরিস্থিতি ইউক্রেনের জন্য শুধু একটি যুদ্ধের প্রশ্ন নয়—এটি একটি অস্তিত্বের প্রশ্ন।
আপনি চাইলে আমি এই বিষয়ে আরও গভীর কূটনৈতিক প্রেক্ষাপট বা ঐতিহাসিক বিশ্লেষণও দিতে পারি।