সালটা ছিল ১৯৮১ সালের ৩০শে মে। এক মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডে স্তব্ধ হয়ে গেল পুরো দেশ। চলে গেলেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। এই শোকের মুহূর্তে ঢাকা সেনানিবাসে দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে অবস্থান করছিলেন এক নারী— বেগম খালেদা জিয়া, যিনি তখন ছিলেন নিতান্তই একজন গৃহবধূ। এদিকে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি তখন বিপর্যস্ত ও দিশেহারা। দলের হাল কে ধরবেন, এই প্রশ্নে নেতারা ছিলেন দ্বিধাগ্রস্ত, আর কোন্দল ছিল প্রবল।
অথচ, রাজনীতির প্রতি খালেদা জিয়ার ছিল গভীর অনীহা। জিয়াউর রহমান যখন ক্ষমতায়, তখনও তিনি লাজুক গৃহবধূ রূপেই সংসার সামলেছেন। সাংবাদিক শফিক রেহমান তাঁকে এভাবেই বর্ণনা করেছেন। কিন্তু কেন এই অনীহা? রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলেন, জিয়াউর রহমানের আকস্মিক হত্যাকাণ্ড তাঁর মনে গভীর দাগ কেটেছিল। তাঁর পারিবারিক জীবন নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল। সাংবাদিক মাহফুজউল্লাহ তাঁর বইয়ে লিখেছিলেন, খালেদা জিয়া হয়তো ভেবেছিলেন, রাজনীতি মানুষকে এমন করুণ পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়।

তবুও, দল টিকিয়ে রাখতে সেই কঠিন সময়ে একদল নেতা-কর্মী দিনের পর দিন তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। ‘আপোষ ফর্মুলা’ হিসেবে খালেদা জিয়াকে বেছে নেওয়া হলো। কর্নেল (অব.) আকবর হোসেন, নুরুল ইসলাম শিশু, একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী এবং মওদুদ আহমদের মতো নেতারাই খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে আনার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। অবশেষে, ১৯৮২ সালের ৭ই নভেম্বর, জিয়াউর রহমানের সমাধিস্থলে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে তিনি প্রথম রাজনৈতিকভাবে আত্মপ্রকাশ করেন।
১৯৮২ সালের তেসরা জানুয়ারি তিনি প্রাথমিক সদস্যপদ পান। এরপর চেয়ারম্যান পদ নিয়ে সাত্তারের সঙ্গে তৈরি হওয়া বিব্রতকর পরিস্থিতি কাটিয়ে তিনি প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করেন। কিন্তু এরশাদের সামরিক অভ্যুত্থানে সাত্তার সাহেব ক্ষমতাচ্যুত হলে, দৃশ্যপট দ্রুত পাল্টায়। রাজনীতিতে সাত্তারের মূল্য আর থাকল না। ১৯৮৩ সালের মার্চে সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান এবং পরে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হয়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে উঠলেন তিনি। ১৯৮৪ সালের ১০ই মে, সামরিক নেতাদের ইচ্ছা বা গোয়েন্দা বিভাগের ভয়কে তুচ্ছ করে, খালেদা জিয়া হলেন বিএনপির চেয়ারম্যান।

এরপরের গল্পটা শুধুই উত্থানের। জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তাঁর আপোষহীন আন্দোলন দেশজুড়ে তৈরি করে ব্যাপক পরিচিতি। রাজনীতিতে আসার মাত্র ১০ বছরের মধ্যেই, ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভ করলো, আর খালেদা জিয়া হলেন বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি নির্বাচনে তিনি জয়ী হয়েছেন।
গৃহবধূ থেকে জননেত্রী হয়ে ওঠা খালেদা জিয়ার এই পথচলা ছিল অনিশ্চয়তা, পারিবারিক শোক এবং সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের এক কঠিন ইতিহাস। আপনার কী মনে হয়, সেই কঠিন সময়ে তাঁর রাজনীতিতে আসা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের গতিপথকে কতটা প্রভাবিত করেছিল? আপনার মতামত জানান কমেন্ট বক্সে।


