সংবিধান সংস্কারের লক্ষ্যে প্রণীত ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’-এর খসড়ায় রাষ্ট্রীয় কাঠামো, রাজনৈতিক ব্যবস্থা, নির্বাচন পদ্ধতি, বিচার বিভাগ ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যাপক পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে মোট ৪৮ দফা সংস্কার প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২৪ সালের জুলাই–আগস্টে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার প্রকাশ ঘটেছে। সেই ঐতিহাসিক ঘটনাকেই ভিত্তি করে নতুন সংবিধান সংস্কারের রূপরেখা তৈরি করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত খসড়ায় বাংলাদেশে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনের কথা বলা হয়েছে—একটি নিম্নকক্ষ জাতীয় সংসদ, অন্যটি উচ্চকক্ষ সিনেট। সিনেটের ১০০ সদস্য সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (PR) পদ্ধতিতে নির্বাচিত হবেন।
এছাড়া নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সংসদ ভেঙে যাওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনে স্পিকার, সরকার ও বিরোধী দলের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি বাছাই কমিটি গঠন করা হবে। প্রয়োজনে বিচার বিভাগের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করে ‘র্যাংকড চয়েজ ভোটিং’ পদ্ধতিতে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচিত হবেন।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, সংসদের দুই কক্ষের সদস্যরা গোপন ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করবেন। রাষ্ট্রপতি মানবাধিকার কমিশন, তথ্য কমিশন, আইন কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংক ও প্রেস কাউন্সিলের প্রধানসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিতে পারবেন। রাষ্ট্রপতির অভিশংসন প্রক্রিয়া দুই কক্ষের যৌথ সিদ্ধান্তে সম্পন্ন হবে।
খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন, তবে তিনি একই সঙ্গে দলীয় প্রধানের পদে থাকতে পারবেন না।
বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিতে জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কমিশন গঠনের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এছাড়া ন্যায়পাল নিয়োগ, দুর্নীতি দমন কমিশনকে সাংবিধানিক মর্যাদা দেওয়া এবং সরকারি কর্ম কমিশনকে তিন ভাগে পুনর্গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হবে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারকদের মধ্য থেকে।
খসড়ায় নারী প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর লক্ষ্যে জাতীয় সংসদে ধাপে ধাপে ১০০ আসনে নারী সদস্য রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোকে ধীরে ধীরে ৩৩ শতাংশ নারী প্রার্থী মনোনয়নের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হবে।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব করে বলা হয়েছে, সংসদ সদস্যরা অর্থবিল ও আস্থা ভোট ছাড়া দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবেন।
রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা বহাল রেখে অন্যান্য ভাষাকে “প্রচলিত ভাষা” হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাবও খসড়ায় রয়েছে। নাগরিক পরিচয়ে শুধু “বাংলাদেশি” শব্দ ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে।
জরুরি অবস্থা ঘোষণায় নতুন সীমাবদ্ধতা, নাগরিক অধিকার ও বিচারিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা, আন্তর্জাতিক চুক্তি সংসদের অনুমোদন ছাড়া কার্যকর না করা, স্থানীয় সরকারের আর্থিক ও প্রশাসনিক স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করার প্রস্তাবও যুক্ত হয়েছে।
এছাড়া সংসদের স্থায়ী কমিটির সভাপতির পদে বিরোধীদলীয় সদস্যদের নিয়োগের বিধান রাখা হয়েছে।
খসড়ার শেষাংশে বলা হয়েছে, গণভোটে অনুমোদন পেলে নতুন সংসদ প্রথম ২৭০ দিনের (নয় মাস) মধ্যে সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে কাজ করবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অনুমোদন না হলে প্রস্তাবগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে।






