মোঃ আল মুবিন মোল্যা
শিক্ষার্থী
দ্বিতীয় বর্ষ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ
এবং
মুহাম্মদ আল্-হেলাল
এমফিল গবেষক(এবিডি)
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
alhelaljudu@gmail.com
+8801782524223
চাকুরীর আন্দোলন বাংলাদেশে লেগেই থাকে। এই তো কিছুদিন আগে ২০২৪ সালে চাকুরীতে কোটা প্রথা
নিয়ে তো সরকারেরই পতন হয়ে গেল। তার কিছুদিন পর হলো সরকারী কর্মকমিশনে পরীক্ষা দেওয়ার
বয়স বাড়ানোর জন্য আন্দোলন। তারপর বেসরকারী ট্রেইনী চিকিৎসকদের বেতন ভাতা বৃদ্ধির জন্য
আন্দোলন। তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমান চলছে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্মরতদের
সুবিধাদি বৃদ্ধির আন্দোলন। আরো অনেক আন্দোলন ইতোপূর্বে হয়েছে তা আমরা হয়তো অনেকেই
জানি। চাকুরীর বেতন ভাতা বৃদ্ধির আন্দোলন নিয়ে কিছুটা বিশ্লেষণ করি। প্রতিবেদন লেখার আগে
আমি google এ নিম্নোক্ত দুইটা লাইন সার্চ করি।
1. Doctor movement for increasing allowance in the USA 2. Doctor movement for
increasing allowance in Bangladesh
প্রথমটার জন্য আমি কোনো কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পায় নি। কিন্তু দ্বিতীয়টির জন্য ১০ থেকে ২০টি
ওয়েবসাইট আমাকে ফলাফল সাজেস্ট করেছে। হয়ত অন্যান্য উন্নত রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে একই
ফলাফল পাওয়া যাবে। তাহলে বেতন ভাতা বৃদ্ধির আন্দোলন উন্নত রাষ্ট্রে হয় না কেন?
উত্তরে অনেকে বলবেন তাদের বেতন কাঠামো তাদের বাজার ব্যাবস্থাপনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
তাহলে ইলন মাস্ক থেকে শুরু করে একজন রাস্তার ঝাড়ুদার সবার বেতন কী বাজারের সাথে
সামঞ্জস্যপূর্ণ। উত্তরটা অবশ্যই “না”। তাহলে যাদের সামঞ্জস্যপূর্ণ না তারা কেন আন্দোলন
করে না?
চিকিৎসকদের আন্দোলনে কয়েকজনকে সাংবাদিকরা জিজ্ঞাসা করলেন “আন্দোলনের কারণ কী?”
উত্তরগুলো ছিল এরকম “এত কম টাকায় আমাদের সংসার চলে না। এর থেকে ড্রাইভারের বেতনও
বেশি ইত্যাদি ইত্যাদি।"
আমার প্রশ্ন কার স্বাপেক্ষে সংসার চলে না? একজন গ্রাম পুলিশের বেতন ৮৫০০ টাকা, একজন
ফায়ার ব্রিগেডেয়ারের বেতন ১৫০০০-১৭০০০ টাকা, একজন জেল পুলিশের বেতন ১৭০০০-১৯০০০
টাকা। বাংলাদেশে আরো অনেক চাকুরীজীবি আছে যাদের বেতন পঁচিশ হাজার টাকার নিচে। তাদের
কীভাবে সংসার চলে? এখন প্রশ্ন আসবে চিকিৎসক আর গ্রাম পুলিশ কী একই? আমি একজন
মেডিকেল শিক্ষার্থী হয়েও ভিন্নতা তো দেখি না।
আপনাকে সরকার পঁচিশ হাজার টাকা ভাতা হিসাবে দেয়। আপনি মনে করেন আপনি এর থেকে বেশী ভাতা
পাওয়ার যোগ্য তাহলে আপনি আপনার চাকুরী/আপনার কর্ম ছেড়ে দিন এবং বেশি আয় করে দেখিয়ে
দিন আপনি বেশি সম্মানী পাওয়ার যোগ্য ছিলেন। আপনি তা পারবেন না। কারণ আপনি কর্ম ছেড়ে দিলে
পঁচিশ হাজার টাকাও আয় করতে পারবেন না। গ্রাম পুলিশের ও ঠিক একই সমস্যা তাই কম বেতন
দেওয়া সত্ত্বেও কাজ করে যাচ্ছে।
উন্নত রাষ্ট্রের চিকিৎসকরা তাদের কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ অর্থ আয় করতে পারলেও আমরা কেন
পারছি না? উত্তরটা স্বাভাবিক দক্ষতার অভাব। এই উত্তরটা হয়তো আগেও শুনেছি আমরা। কেন
দক্ষতার অভাব সেটা দেখে আসি।
আমাদের দেশে বছরে একবার সরকারী/বেসরকারী মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।
ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীকে- ১. জীববিজ্ঞান(উদ্ভিদবিদ্যা ও প্রাণিবিদ্যা) ২. রসায়ন ৩.
পদার্থবিজ্ঞান ৪. ইংরেজী ৫. সাধারণ জ্ঞান বিষয়ে যাচাই করা হয়।
এবার আসি যুক্তরাষ্ট্রের মেডিকেল কলেজের ভর্তি পদ্ধতিতে। প্রথমে শিক্ষার্থীকে একবছর প্রি
মেডিকেলের উপর কোর্স করতে হয়। প্রি মেডিকেলের সাবজেক্ট: 1. Human Physiology 2.
Human Anatomy 3. Human Biochemistry
উপরোক্ত সাবজেক্টগুলোর উপর ভিত্তি করে যাচাই করা হয়। যার প্রত্যেকটা মানব শরীর
সম্পর্কিত। আমাদের কারিকুলামে একজন শিক্ষার্থী পদার্থবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান বা সাধারণ
জ্ঞান সম্পর্কে ভালো জ্ঞান রাখলেও মেডিকেলে ভর্তি হতে পারবে। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞান,
উদ্ভিদবিজ্ঞান বা সাধারণ জ্ঞান তার পরবর্তীতে খুব একটা লাগবে বলে আমার মনে হয় না। যেহেতু
আমাদের বাছাই পদ্ধতিটায় পেশার সাথে সম্পর্ক রেখে বাছাই করা হয় না। তাই কেউ নির্দিষ্ট কোনো
বিষয়ে বিশেষ দক্ষতা রাখে না।
যখন সরকারি ব্যাংকগুলোকে লিমিটেড ঘোষণা করা হলো ঠিক তার পরেরদিন ঐ ধরনের ব্যাংকে
কর্মরত আমাদের অতি পরিচিত পাশের গ্রামের একজন আমাদের বাসায় এসে তার ব্যাংকের বিভিন্ন
সার্ভিস গ্রহণ করার জন্য কনভিন্স করার চেষ্টা করছিলেন। তিনি আমাদের অনেক দিনের পরিচিত
হলেও এর আগে কখনো তার ব্যাংকের সার্ভিস বিষয়ে তেমন কোন কথা বলেননি।
আমি সাধারণত কোন কিছু কোথাও পাঠানোর প্রয়োজন হলে পোস্ট অফিসের সার্ভিস ব্যবহার করার
চেষ্টা করি। শুধু পোস্ট অফিসের সার্ভিস নয় সরকারি অনেক অফিসের সার্ভিস গ্রহণ করতে গেলে
শুনতে হয়েছে "সরকারি সার্ভিস ভাল নয় বরং বেসরকারি অফিসে যান"।
আমাদের একভাই সরকারি প্রকল্পভুক্ত পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ইন্স্ট্রাক্টর ছিলেন। চাকরিটা
প্রকল্পভুক্ত হওয়ায় তিনি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নিম্ন গ্রেডে জয়েন করেন। পরবর্তীতে
পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট প্রকল্প রেভিনিউ হলে ঐ ভাইয়ের আফসোস হয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পে চাকরি করা অবস্থায় মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে প্রচুর
কাজ থাকত। হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ এবিসি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় উপজেলা শহরের একটু পাশে
অবস্থিত। একটি বালিকা বিদ্যালয় উপজেলার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত। একজন শিক্ষক প্রতিষ্ঠান
সরকারি হওয়ার প্রত্যাশায় এবিসি পাইলট থেকে বিধি মোতাবেক বালিকা বিদ্যালয়ে যোগদান করেন।
কিছুদিন পর এবিসি পাইলট স্কুলটি সরকারিকরণ হলে ঐ শিক্ষক তার আমার প্রকাশ করতে গিয়ে
বলেছিলেন যে, "বালিকা বিদ্যালয় কে সরকারি না করে এবিসি পাইলট কোন যুক্তিতে সরকারি হয়"।
অন্যদিকে আমার একভাই সরকারি অফিস সহকারি পদের চাকরি ছেড়ে বেসরকারি চাকরিতে যোগদান
করেন। বর্তমান তার পরিবারসহ তিনি কানাডার নাগরিক এবং বাংলাদেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে
উচ্চ বেতনে নির্বাহী পরিচালক পদে জব করছেন। এরকম অহরহ উদাহরণ রয়েছে।
গতকাল বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এক কর্মচারির সাথে কথা প্রসঙ্গে জানতে চাইলাম কিসের
আন্দোলন চলছে। তিনি বললেন বাড়ি ভাড়া, বেতন বৃদ্ধি আর জাতীয়করণের জন্য। জানতে চাইলাম
যোগদানের সময় বেতন কত ছিল, এখন কত? তিনি বললেন তখন মাত্র ৩০০+ ছিল এখন ভালোই পাই।
বললাম চাকরিতে যোগদানের সময় আপনাকে কি প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল যে কিছুদিন পর পর
সুবিধাদি বৃদ্ধি এবং চাকরি জাতীয়করণ করা হবে কিন্তু সরকার এখন সেই প্রতিশ্রুতি রাখছেনা। তিনি
বললেন না। আমি বললাম তাহলে আন্দোলন কেন? সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা সুবিধা বেশি
আর আমাদের কম। বললাম তাহলে বর্তমান চাকরি ছেড়ে যেখানে সুবিধা বেশি সেখানে যান। কিছুদিন
পরপর আন্দোলন তো দেশের জন্য অসুবিধা। তিনি আর কোন জবাব দিলেন না।
দেশের বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মরতরা সরকারিকরণের জন্য আন্দোলন করে আবার
শোনা যায় ভিকারুননিসা নুন স্কুল, ঢাকা রেসিডেনসিয়াল কলেজ, উত্তরা রাজউক কলেজের মতো
স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানকে সরকারি করতে চাইলেও তারা রাজী হয়না। এর মূল কারণ হলো বেসরকারি
চাকরিতে চ্যালেঞ্জ আছে। সেখানে স্কীল ডেভেলপ করে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারলে ভালো
ইনসেনটিভ পাওয়া যায়। অন্যদিকে সরকারি চাকরি হারানোর ভয় কম ফলে যারা স্কীল্ড নয় এবং
স্কীল ডেভেলপ করতেও চায়না তারা কোনরকম একটি সরকারি চাকরি করে জীবন পার করতে চায়।
যেহেতু আমরা কোনো বিষয়ে বিশেষভাবে দক্ষ নই। আমরা নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করে কর্মসংস্থান
সৃষ্টি করতে পারি না। তাই সব সময় একটা চাকুরীর ভরসায় থাকি। আর কোথাও চাকুরীর সামান্য
সম্ভাবনা দেখি সেখানেই ঝাঁপিয়ে পড়ি এবং কর্মরত চাকরিতে আন্দোলন করে দেশের জান-মালের
ক্ষতি করে সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করার চেষ্টা করি। উল্লেখ্য শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা না বুঝাতে পেরে
বেত্রাঘাত করা এবং প্রতিশ্রুত শর্তে চাকরিতে যোগদান করে কিছু দিন পর পর রাষ্ট্রের ক্ষতি করে
আন্দোলন করা সন্ত্রাসী কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত।
সুতরাং যারা একটি নির্দিষ্ট শর্তে চাকরিতে যোগদান করে কিছু দিন পর পর সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির
জন্য আন্দোলন করেন তাদের প্রতি আহ্বান আপনারা সন্ত্রাসী কার্যক্রম ছেড়ে নিজেদের স্কীল
ডেভেলপ করে যেখানে সুবিধা বেশি পান সেখানে যোগদান করুন। রাষ্ট্রের জন্য জরুরি জাতির কল্যাণে
রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সংক্রান্ত কিছু ডিপার্টমেন্টকে সরকারি রেখে বাকী প্রায় সব প্রতিষ্ঠান
বেসরকারিকরনের উদ্দ্যোগ গ্রহণ করা।