২০২৫ সালের মার্চ মাসে, দ্বিতীয়বার মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে তার প্রথম ভাষণে একটি চমকপ্রদ তথ্য প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ২০২১ সালের আগস্টে আফগানিস্তানের কাবুল বিমানবন্দরে ‘আবেই গেট’ নামে পরিচিত প্রবেশপথে যে আত্মঘাতী বোমা হামলায় বহু মানুষ নিহত হয়েছিল, তার সন্দেহভাজন একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ট্রাম্প আরও বলেন, এই সাফল্যের জন্য তিনি বিশেষভাবে পাকিস্তান সরকারকে ধন্যবাদ জানাতে চান। তার ভাষায়, “এই দানবকে গ্রেফতার করতে সাহায্য করার জন্য আমি পাকিস্তান সরকারকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাই।”
এই মন্তব্যের প্রায় তিন মাস পর, পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির পাঁচ দিনের যুক্তরাষ্ট্র সফরের অংশ হিসেবে হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের আমন্ত্রণে মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন। এটি একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা, কারণ এর আগে কখনও কোনও পাকিস্তানি সেনাপ্রধান, যিনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী নন, মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে এমন সরাসরি আতিথেয়তা পাননি।
এই ঘটনাগুলোর মধ্য দিয়ে একটি স্পষ্ট বার্তা পাওয়া যাচ্ছে—পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক একটি নতুন মোড়ে প্রবেশ করেছে। যেখানে মাত্র সাত বছর আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প টুইটে পাকিস্তানকে “মিথ্যা ও প্রতারণার আশ্রয়দাতা” বলে অভিযুক্ত করেছিলেন, সেখানে এখন তিনি পাকিস্তানকে সরাসরি প্রশংসা করছেন এবং সেনাবাহিনীর সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছেন।
এই সম্পর্ক পুনর্গঠনের অন্যতম কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা দেখছেন মে মাসে ঘটে যাওয়া ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত উত্তেজনা। কাশ্মীর অঞ্চলে একটি বোমা হামলায় ২৬ জন ভারতীয় নাগরিক নিহত হওয়ার পর ভারত পাকিস্তানকে দোষারোপ করে। এরপর ভারত পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীর অঞ্চলে হামলা চালায়, যার জবাবে পাকিস্তানও সামরিক প্রতিক্রিয়া জানায়। পরিস্থিতি ক্রমে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং একপর্যায়ে দু’দেশ ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে পরস্পরের ওপর আঘাত হানে। এই সংঘর্ষ তিন দিন ধরে চলে এবং একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতার মাধ্যমেই একটি যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছানো সম্ভব হয়।
ট্রাম্প দাবি করেন, তিনি নিজে এই যুদ্ধ থামাতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। তার ভাষায়, “আমি পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ থামিয়েছি। এই মানুষটি—জেনারেল মুনির—এটি থামাতে পাকিস্তান পক্ষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, আর মোদি ভারতের পক্ষ থেকে। এই দুই বুদ্ধিমান মানুষ একটি সম্ভাব্য পারমাণবিক যুদ্ধ এড়াতে রাজি হয়েছেন।” যদিও ভারত এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, যুদ্ধবিরতি তাদের দ্বিপাক্ষিক আলোচনার ফল।
মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সংকট—বিশেষ করে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সাম্প্রতিক যুদ্ধাবস্থা—পাকিস্তানের ভূরাজনৈতিক অবস্থানকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। ইসরায়েল জুনের মাঝামাঝি থেকে ইরানে একাধিক আক্রমণ চালিয়েছে, যার জবাবে ইরানও ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়েছে। এর ফলে দুই শতাধিক ইরানি নিহত হয়েছেন এবং ইসরায়েলে অন্তত ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। ট্রাম্প বলেন, পাকিস্তান ইরান সম্পর্কে খুব ভালো জানে এবং এই মুহূর্তে তাদের অভিজ্ঞতা ও কূটনৈতিক ভারসাম্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
এই পুনর্গঠিত সম্পর্ক মূলত প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সহযোগিতার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ডের (CENTCOM) প্রধান জেনারেল মাইকেল কুরিলার মতে, কাবুল হামলার সন্দেহভাজনকে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী গ্রেফতার করেছে এবং জেনারেল মুনির নিজে ফোন করে তাকে বিষয়টি জানান। CENTCOM প্রধান বলেন, “তারা এখনই সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে সক্রিয় এবং এই দিক থেকে তারা দুর্দান্ত এক সহযোগী।”
এই সম্পর্ক শুধু নিরাপত্তা দৃষ্টিকোণেই সীমাবদ্ধ নয়। পাকিস্তান এখন যুক্তরাষ্ট্রকে বেশ কিছু আকর্ষণীয় প্রস্তাব দিচ্ছে—যেমন শুল্কমুক্ত বাণিজ্যের সুযোগ, বিরল খনিজ সম্পদের বিনিয়োগ, এমনকি ক্রিপ্টোকারেন্সি সহযোগিতার কথাও উঠে এসেছে। পাকিস্তান সম্প্রতি একটি ‘ক্রিপ্টো কাউন্সিল’ গঠন করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সম্পর্ক মূলত ব্যক্তি কেন্দ্রিক ও অস্থায়ী। মার্কিন নীতি বিশেষজ্ঞ মারভিন ওয়েইনবাম বলেন, “এই প্রশাসনে কিছুই স্থায়ী নয়। এখানে কোনও প্রক্রিয়া নেই, সিদ্ধান্তগুলো মুহূর্তে মুহূর্তে বদলায়।”
নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক গবেষক রেজা রুমি বলেন, “যতক্ষণ না এই সম্পর্ক প্রাতিষ্ঠানিক হয়, এটি শুধুই একটি কৌশলগত রোমান্স। অতীতের মতোই, লক্ষ্য পূর্ণ হলে বা সরকার বদলালে সম্পর্ক আবার হিমায়িত হয়ে পড়তে পারে।”
অন্যদিকে, পাকিস্তানের ভেতরে এই বৈঠকের প্রভাবও গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর দীর্ঘদিনের কর্তৃত্ব রয়েছে এবং বর্তমান সরকারও অনেকের মতে সরাসরি সেনাবাহিনীর সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত। অতীতে, সামরিক শাসক আইয়ুব খান, জিয়াউল হক এবং পারভেজ মোশাররফ মার্কিন রাষ্ট্রপতিদের কাছ থেকে দাওয়াত পেয়েছিলেন—তবে তাঁরা রাষ্ট্রপতি ছিলেন। এবার এই নজির ভেঙে একজন সেনাপ্রধান এই সম্মান পেলেন।
বিশ্লেষক আরিফ আনসার বলেন, পাকিস্তানের সাম্প্রতিক সামরিক সক্ষমতা এবং আঞ্চলিক কৌশলগত ভূমিকা ট্রাম্পকে আবার পাকিস্তানের দিকে নজর দিতে বাধ্য করেছে। তার মতে, পাকিস্তান এখন একটি বড় কৌশলগত সিদ্ধান্তের মুখোমুখি—চীন নাকি যুক্তরাষ্ট্র, কোন পক্ষকে অধিক প্রাধান্য দেবে। এই সিদ্ধান্ত আবার ইরান সংকট, চীন-মার্কিন উত্তেজনা এবং ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুর সাথে জড়িত।
সবশেষে, এই নতুন সম্পর্কের গতি কী হবে তা সময়ই বলবে। যতক্ষণ পর্যন্ত এটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ না পায় এবং শুধু নিরাপত্তা-ভিত্তিক না হয়ে বাণিজ্য, শিক্ষা ও সংস্কৃতি পর্যন্ত বিস্তৃত না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত এই সম্পর্ক একটি অস্থায়ী কৌশলগত চুক্তি হিসেবেই থেকে যেতে পারে।