এস এম মাহফুজ আহমেদ, চবি প্রতিনিধি:
উচ্চশিক্ষায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এখন আর শুধু গবেষণার বিষয় নয়, বরং শিক্ষার্থীদের নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছে। ChatGPT, Gemini, Grammarly থেকে শুরু করে বিভিন্ন AI টুলস প্রতিদিনের পড়াশোনা, গবেষণা এবং অ্যাসাইনমেন্টে ব্যবহার করছে শিক্ষার্থীরা। কিন্তু এই ব্যবহার কতটা ন্যায্য? AI কি শিক্ষার সহায়ক, নাকি এক ধরনের নির্ভরশীলতা তৈরি করছে? বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে AI এখন শুধু প্রযুক্তির বিষয় নয়, এটি প্রতিটি বিভাগের শিক্ষার্থীর নীরব সঙ্গী হয়ে উঠেছে। কেউ এটাকে ‘লাইফ সেভার’ বলছে, আবার কেউ একে ‘একাডেমিক ইন্টিগ্রিটি’র জন্য হুমকি মনে করছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিভিন্ন ফ্যাকাল্টির বিভিন্ন শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনায় উঠে এসেছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এর বিজ্ঞান অনুষদের রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী মো. রেজাউল করিম বলেন, “AI টুলস রিসেন্ট এসেছে। আমি এর আগে বই, অন্যান্য সোর্স বা শিক্ষক থেকেই সমাধান নিতে চেষ্টা করতাম, যেটা সময় সাপেক্ষ ছিলো। AI টুলস আমাকে স্বল্প সময়ে সহজে তথ্য খুজতে সাহায্য করে, অল্টারনেট ওয়ে অফ থিংকিং শেখায়। সামারি করার ব্যাপারেও এআই চমৎকার পারদর্শী।”
অপরদিকে একই অনুষদের গণিত বিভাগের এক শিক্ষার্থীর মতে AI টুলসগুলো ব্যবহার করে কোডিং এসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশন তৈরী আর্টওয়ার্ক ইত্যাদি করলেও আগে ম্যানুয়ালি কাজ করার সময় যেই ব্রেইন্সটর্মিংটা হতো, সেটা আর হয় না। বেশি বেশি অপশন থাকার ফলে আইডিয়া কম আসে।”
কিন্তু কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে দেখা যায় যে তাদের AI টুলসের ব্যবহার আরোও সীমিত। তারা সাধারণত AI কে সাধারণ প্রশ্নের ন্যায় প্রম্পট/নির্দেশনা দিয়ে থাকে। এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভিন্ন ভিন্ন ব্যবহারকারীকে AI টুলগুলো সাদৃশ্যমূলক উত্তর দিয়ে থাকে। তবে কিছু শিক্ষার্থী মনে করেন AI কে যদি কার্যকরীভাবে নির্দেশনা/প্রম্পট দেয়া যায় তবে তার আউটপুট অনেক ভালো হয়। যেমন শিক্ষা ও গবেষণার এক শিক্ষার্থীর বলেন “আমি নির্দিষ্ট কোন ওয়েব পেইজের লিংক কিংবা কোনো পিডিএফ ফাইল অথবা তথ্য সম্বলিত কোন ছবি ডকুমেন্ট হিসেবে সংযুক্ত করে দেই। এরপর প্রম্পটে আমি এনালাইসিস চাইলে এনালাইসিস বা নির্দেশনা অনুসারেই উত্তর জেনারেট করে। ঐ উত্তরের রেস্পন্সে বারবার ইন্সট্রাকশন দিয়ে আরো বিস্তারিত উত্তর পাওয়া যায়।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী আশেকুর রহমান মনে করেন “বিভাগের কোর্সে AI/Adaptive Learning প্ল্যাটফর্মের প্রয়োগ মার্কেটিংয়ের স্টুডেন্টদের জন্য একদম পার্সোনালাইজড লার্নিং এক্সপেরিয়েন্স দিতে পারে। এটা ডিজিটাল স্কিল ডেভেলপমেন্টে হেল্প করে।” কিন্তু সিএসই বা, বিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট অনুষদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে AI টুলসগুলোর ভার্সেটাইল ব্যবহার বেশি দেখা যায়।
আবার, নাট্যকলার শিক্ষার্থী রাশেদুল ইসলাম বলেন “AI কে নাটকের কোন স্ক্রিপ্ট লিখতে বললে সে গড়পড়তা কিছু লিখবে কিন্তু তাতে মানব মস্তিষ্ক প্রসূত কল্পনা শক্তির বহিঃপ্রকাশ থাকবে না, আবেগের বহিঃপ্রকাশ থাকবে না। স্টোরিটেলিং বা আইডিয়া জেনারেশনের কাজে AI কখনো মানুষের স্থান নিতে পারবে না।”
বর্তমানে শিক্ষার্থীরা তাদের অ্যাসাইনমেন্ট বা বিভিন্ন কাজে AI টুলসের অতিরিক্ত ব্যবহার করছে, যা প্রায়শই সরাসরি কপি-পেস্টের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এর শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের শিক্ষক ড. গোলাম মহিউদ্দিন এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন যে AI এর প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার্থীদের জন্য সহায়ক হিসেবে কাজ করা, যেখানে এটি নির্দিষ্ট বিষয়ে প্রাসঙ্গিক তথ্য খুঁজে বের করতে সহায়তা করবে। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষার্থীরা তাদের চিন্তাভাবনা এবং সমালোচনামূলক বিশ্লেষণের দায়িত্বও এর উপর ছেড়ে দিচ্ছে, যা তাদের সৃজনশীলতা ও মেধার বিকাশে বাধা সৃষ্টি করছে। এই সমস্যা সমাধানে তিনি Turnitin-এর মতো AI ভিত্তিক প্ল্যাজিয়ারিজম শনাক্তকরণ সফটওয়্যার ব্যবহারের পরামর্শ দেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ইতিমধ্যে এই টুলটি ব্যবহার শুরু করেছে, যা শিক্ষার্থীদের নকল করা রোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। তবে তিনি সতর্ক করে দেন যে প্রযুক্তি কখনই শিক্ষার বিকল্প হতে পারে না, বরং তা শিক্ষার্থীদের মেধা ও সৃজনশীলতা বিকাশের সহায়ক হিসেবেই ব্যবহৃত হওয়া উচিত। শেষ পর্যন্ত, নিজস্ব চিন্তা ও সৃজনশীলতার বিকাশই প্রকৃত শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।”
অপরদিকে একই বিভাগের শিক্ষক মুহাম্মদ আমির উদ্দিন বলেন, “AI ব্যবহারের জন্য শিক্ষার্থীদের মৌলিক জ্ঞান থাকা অপরিহার্য, কারণ AI শুধু বিদ্যমান ডেটা বিশ্লেষণ করতে পারে। এটি সৃজনশীল কাজে সহায়তা করতে পারলেও কখনই রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলের মতো মৌলিক সৃষ্টি করতে পারে না। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কারিকুলাম ডিজাইন থেকে গবেষণা পর্যন্ত AI প্রয়োগের সুযোগ রয়েছে কিন্তু তা সময়সাপেক্ষ। তবে মনে রাখতে হবে AI কখনোই মানুষের মৌলিক চিন্তা ও সৃজনশীলতার বিকল্প হতে পারে না। প্রযুক্তিকে সহায়ক হিসেবে ব্যবহার করাই বুদ্ধিমানের কাজ।”
শিক্ষার্থীদের জন্য কিছু অপরিহার্য ওয়েবসাইট যা তাদের শেখার গতিকে তরান্বিত করবে এবং শিখনকে দীর্ঘস্থায়ী করবে (সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ব্যবহারযোগ্য):
১. Khan Academy (khanacademy.org) – গণিত, বিজ্ঞান, কম্পিউটার সায়েন্সসহ বিভিন্ন বিষয়ের ইন্টারেক্টিভ ভিডিও লেকচার
২. Coursera (coursera.org) – বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ফ্রি কোর্স (অডিট মোড)
৩. Duolingo (duolingo.com) – ভাষা শেখার ইন্টারেক্টিভ প্ল্যাটফর্ম
৪. Google Scholar (scholar.google.com) – একাডেমিক রিসার্চ পেপার ও জার্নাল খোঁজা
৫. TED-Ed (ed.ted.com) – শিক্ষামূলক অ্যানিমেটেড ভিডিও, শিক্ষকদের জন্য লেসন প্ল্যান
৬. Otter.ai (otter.ai) – লেকচার রেকর্ডিং এবং স্বয়ংক্রিয় ট্রান্সক্রিপশনের সুবিধা দেয়
৭. Codecademy (codecademy.com) – প্রোগ্রামিং ভাষা শেখার ইন্টারেক্টিভ প্ল্যাটফর্ম
৮. ChatGPT (chat.openai.com) – রচনা প্রস্তুত, গবেষণা বিষয়বস্তু বোঝা এবং আইডিয়া জেনারেট করতে সহায়তা করে।
৯. Google Bard (bard.google.com) – বাস্তব সময়ের তথ্য অনুসন্ধান এবং বিভিন্ন উৎসের ডেটা তুলনা করার জন্য উপযোগী।
১০. QuillBot (quillbot.com) – লেখার মান উন্নয়ন, প্যারাফ্রেজিং এবং সারাংশ তৈরিতে সহায়ক।
১১. Canva (canva.com) – প্রেজেন্টেশন, ইনফোগ্রাফিক এবং অন্যান্য শিক্ষামূলক ডিজাইন তৈরিতে সহায়তা করে।
১২. Wolfram Alpha (wolframalpha.com)- জটিল গাণিতিক সমীকরণ এবং বৈজ্ঞানিক সমস্যার সমাধান প্রদান করে।
প্রতিবেদক: সাদিয়া হাসনাত, এইচ.এম. সাকিব নূর, মোফাখখারুল ইসলাম ভূঁইয়া টিটু (শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়)