‘আমি যদি দেখি, যারা পিলখানায় আমার স্বামীসহ সেনা কর্মকর্তাদের পৈশাচিকভাবে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে, গুলি করে হত্যা করেছে, তাঁদের লাশ ড্রেনে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে, পুড়িয়ে ফেলেছে, গর্ত খুঁড়ে মাটিচাপা দিয়েছে, আমাদের বাসায় লুটপাট চালিয়েছে, আমাদের পরিবারের নারী ও শিশুদের কোয়ার্টার গার্ডে আটকে রেখে চরম নির্যাতন চালিয়েছে, সেই অপরাধীরা কারামুক্ত হয়ে আমাদের চোখের সামনে বুক ফুলিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে—তাহলে ভাবব এই দেশ আমার না, আমাদের সন্তানদের না, আমাদের সেনা পরিবারগুলোর না।’
এই কথাগুলো ২০০৯ সালে পিলখানায় বিপথগামী বিডিআর সদস্যদের হাতে নিহত শহীদ কর্নেল মো. মুজিবুল হকের স্ত্রী নেহরীন ফেরদৌসীর।
ড্রেনে ভেসে সেই লাশ কামরাঙ্গীর চরে চলে যায়। লাশটি ছিল ক্ষতবিক্ষত। মাথার খুলি ভাঙা। একাধিক ক্ষত ছিল শরীরে।
বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে এবং গুলি করে তিনতলা থেকে তাঁকে নিচে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।’
তিনি বলেন, ‘পিলখানায় সেনা কর্মকর্তাদের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সংশ্লিষ্ট বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় সম্প্রতি অনেক বিডিআর জওয়ান জামিনে মুক্ত হয়েছেন। যদিও তাঁরা এখনো অভিযোগমুক্ত নন। কিন্তু তাঁদের কারামুক্তি নিয়ে যে ধরনের আনন্দ-উল্লাস প্রকাশ হয়েছে তাতে আমরা ব্যথিত এবং আতঙ্কিত।
যাঁরা এখনো কারাবন্দি তাঁদের মুক্তির দাবি নিয়ে আন্দোলনের ঘটনাও ঘটছে। এ অবস্থায় আমরা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। নানাভাবে হুমকিও আসছে।’
শহীদ কর্নেল কুদরত ইলাহী রহমান শফিকের পুত্র সাকিব রহমান বলেন, ‘যাঁরা বিস্ফোরক মামলায় জামিন পেয়েছেন, জামিন তাঁদের অধিকার হলেও তাঁদের এখনো নির্দোষ বলা যাবে না। জামিন মানেই অভিযোগমুক্ত নয়।
https://52f681f36084ef84fc051a6aa2487e21.safeframe.googlesyndication.com/safeframe/1-0-40/html/container.htmlতাই তাঁদের পিলখানা ঘটনার ‘ভিকটিম’ হিসেবে ব্যাকগ্রাউন্ডে দুঃখের মিউজিক দিয়ে গণমাধ্যমগুলো যেভাবে তাঁদের জামিনে মুক্ত হওয়ার বিষয়টি প্রচার করছে, সেটা শহীদদের জন্য অপমানজনক এবং শহীদ পরিবারের জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক।
শহীদ মেজর মো. আব্দুস সালাম খানের সন্তান সাকিব মাহমুদ খান প্রীতমও কালের কণ্ঠকে এ বিষয়ে তাঁর উদ্বেগের কথা জানান। তিনি জানান, রাজধানীর পিলখানায় ২০০৯ সালে তৎকালীন বিডিআরে নিযুক্ত ৫৭ জন নিরস্ত্র সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যা, লাশ গুম, তাঁদের বাসায় লুটপাট এবং পরিবারের সদস্যদের ওপর নির্যাতন চালানোর অভিযোগে অভিযুক্ত-সাজাপ্রাপ্ত বিডিআর জওয়ানদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলনের ঘটনায় হতাশ শহীদ সেনা পরিবারের সদস্যরা।
প্রীতম বলেন, ‘ওই অপরাধে যাঁরা অভিযুক্ত, দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন এবং যাঁরা সাজাপ্রাপ্ত, তাঁদের নিরপরাধ দাবি করে মুক্তি চাওয়ার বিষয়টিকে আমরা মেনে নিতে পারি না।’
গত বুধবারও নিজেদের এই বেদনাদায়ক অনুভূতির কথা জানাতে পিলখানায় শহীদ সেনা পরিবারগুলোর সদস্য এবং সেদিন মৃত্যুপুরি থেকে বেঁচে ফেরা সেনা কর্মকর্তারা রাজধানীর মহাখালীর রাওয়া ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন।
তাঁরা বলেন, বিডিআর কোর্টের সাজা নিয়ে প্রশ্ন করা মানে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের তথা সেনাবাহিনীকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। অভিযুক্ত ও সাজাপ্রাপ্ত বিপথগামী জওয়ানদের নিরপরাধ বলার কোনো সুযোগ নেই এবং তাঁদের মুক্তির দাবি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। আমাদের একান্ত দাবি, সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীদের প্রাপ্য সাজা অবিলম্বে কার্যকরের মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে বাহিনীটিকে কলঙ্কমুক্ত করা হোক। সঠিক বিচার না হলে ভবিষ্যতে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন পিলখানায় শহীদ লেফটেন্যান্ট কর্নেল লুত্ফর রহমান খান এএমসির মেয়ে ডা. ফাবলিহা বুশরা।
এতে বলা হয়, অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই, বিডিআর কার্নেজে (গণহত্যা) অভিযুক্ত-সাজাপ্রাপ্ত সৈনিক ও তাঁদের পরিবারকে গত ১৫ বছর কোনো দাবি নিয়ে মাঠে আসতে আমরা দেখিনি, কিন্তু আজ তাঁরা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক দাবি নিয়ে বিপথগামী সৈনিকদের নিরপরাধ দাবির আন্দোলনের মাধ্যমে জাতিকে বিভ্রান্ত করে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালুর অপচেষ্টা করছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এই দাবির মাধ্যমে জাতির দৃষ্টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে প্রকৃত খুনিদের আড়াল এবং বর্তমান ছাত্র-জনতার সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টা করা হচ্ছে। এটি সেনা কর্মকর্তা ও সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি নষ্ট করারও অপপ্রয়াস। এই খুনিদের যথাযথ বিচার না হলে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে, যা মোটেও কাম্য হতে পারে না। ২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় সংঘটিত হয় পৃথিবীর ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম হত্যাযজ্ঞ। সেদিন নির্মমভাবে হত্যা করা হয় কর্তব্যরত নিরস্ত্র-নিরপরাধ ৫৭ জন বিডিআর কর্মকর্তা তথা সেনা কর্মকর্তাকে, তাঁদের লাশ বিকৃত করা হয়, লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ট্রাকে লোড করা হয়, পৈশাচিকভাবে লাশ ক্ষতবিক্ষত করে মাটিচাপা দেওয়া হয়, ড্রেনে ফেলে দেওয়া হয় এবং গুম করা হয়। কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যদের হত্যা ও নির্যাতন করা হয়। সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে নিরীহ, নিরপরাধ নারী ও শিশুদের টেনেহিঁচড়ে চরম নির্যাতনের মাধ্যমে ধরে এনে কোয়ার্টার গার্ডে বন্দি করা হয়। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া বেশির ভাগ কর্মকর্তাকেই শারীরিকভাবে চরম নির্যাতন করা হয়, কর্মকর্তাদের বাসস্থানে ব্যাপক ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, চুরি-ডাকাতি করা হয়। কর্মকর্তাদের গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়, ব্যক্তিগত ও সরকারি সম্পত্তির ব্যাপক ধ্বংসের মাধ্যমে পিলখানাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয়। বিপথগামী বিডিআর জওয়ানদের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি সংঘটিত ওই অপরাধের চাক্ষুষ সাক্ষী আমরা শহীদ পরিবার ও বেঁচে ফেরা কর্মকর্তারা। সাক্ষী মিডিয়ার ছবি ও ভিডিও, যা সারা পৃথিবী অবলোকন করেছে।’
আরো বলা হয়, ‘সেদিন পিলখানায় প্রায় পাঁচ হাজার বিডিআর সদস্য এবং চার হাজারের মতো অস্ত্র মজুদ ছিল। বিডিআর জওয়ানরা আধাঘণ্টার মধ্য অস্ত্রাগার লুট করে সব অস্ত্র বের করে নেন এবং সরাসরি কার্নেজে ব্যবহার করেন। সেদিন যে শুধু পিলখানায় বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছে তা নয়, বিপথগামী বিডিআর সৈনিকদের উসকানির মাধ্যমে সারা দেশের রাইফেল ব্যাটালিয়ন ও ট্রেনিং সেন্টারে বিদ্রোহ সংঘটিত হয়।’