২০২৫ সালের ১৪ মে মিয়ানমার-ভারত সীমান্তের উত্তপ্ত বাস্তবতায় এক রক্তাক্ত ঘটনা ঘটে যায়, যা দুই দেশের সীমান্ত নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক সম্পর্ককে নতুন করে নাড়া দেয়। ভারতের আধাসামরিক বাহিনী আসাম রাইফেলস মণিপুর রাজ্যের চান্দেল জেলায় অভিযান চালিয়ে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে লড়াইরত বিদ্রোহী গোষ্ঠী পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস (পিডিএফ)-এর অংশ হিসেবে পরিচিত পা কা ফা বা পিকেপি’র ১০ সদস্যকে গুলি করে হত্যা করে। নিহতদের মধ্যে তিনজন কিশোর থাকায় ঘটনা ঘিরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগও উঠতে শুরু করে।
ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভাষ্যমতে, নিহতরা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল এবং আসাম রাইফেলসের একটি টহল দলের ওপর গুলি চালানোর জবাবে পাল্টা গুলি ছুঁড়ে তাদের হত্যা করা হয়। মন্ত্রণালয় জানায়, ঘটনাস্থল থেকে সাতটি একে-৪৭ রাইফেল ও একটি রকেটচালিত গ্রেনেড লঞ্চার উদ্ধার করা হয়, এবং নিহতরা সামরিক পোশাক পরিহিত ছিল। কিন্তু এসব দাবি চ্যালেঞ্জ করে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বিরোধী গঠিত ছায়া সরকার, ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি)। এনইউজি’র পক্ষ থেকে বলা হয়, ভারতীয় বাহিনী তাদের অবস্থান সম্পর্কে আগে থেকেই জানত এবং এই তথ্য মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরবরাহ করেছিল। ফলে ভারতীয় বাহিনীর এই অভিযানকে পরিকল্পিত এবং নিষ্ঠুর হত্যা বলেই মনে করছে তারা। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা জানায়, নিহতরা তামুর জেলার একটি পিডিএফ ক্যাম্পে অবস্থান করছিল, এবং তাদের আটক করে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছে—এমন দাবিও উঠেছে।
এই অভিযানের পর ভারতের পক্ষ থেকে একাধিক বিবৃতি প্রকাশিত হয়, যা পরিস্থিতিকে আরও ধোঁয়াশাপূর্ণ করে তোলে। ১৬ মে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়, টহল দলকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো হলে আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি ছোড়া হয়। কিন্তু পরবর্তী বিবৃতিতে, ২১ মে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় নিহতদের ‘পিকেপির ক্যাডার’ হিসেবে ঘোষণা করে জানায়, সীমান্তে বেড়া নির্মাণে বাধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে তারা হামলা চালাতে এসেছিল। এই বৈপরীত্যপূর্ণ বিবৃতি ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
ঘটনাটি সীমান্তবর্তী অঞ্চলে প্রচণ্ড উদ্বেগ ও আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থী এবং স্থানীয় বাসিন্দারা নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছে। কারণ, এ ধরনের অভিযান ভবিষ্যতে আরও বাড়তে পারে এবং নিরীহ জনগণের ওপর তার প্রভাব পড়তে পারে। অন্যদিকে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বহুদিন ধরেই দাবি করে আসছে যে মিয়ানমার থেকে আগত অনুপ্রবেশকারীরা মণিপুরের জাতিগত সহিংসতাকে উস্কে দিচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ প্রকল্প আরও বড় ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে, যা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা জাতিগত দ্বন্দ্বকে নতুন মাত্রা দিয়েছে।
রাজনীতি বিশ্লেষক ও গবেষক অংশুমান চৌধুরী মনে করেন, এই ঘটনাটি মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ককে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করতে পারে। তিনি সতর্ক করেন, “এই হত্যাকাণ্ড ভারতীয় বাহিনী এবং মিয়ানমারের বিদ্রোহীদের মধ্যকার সংঘর্ষের ধরন পাল্টে দিতে পারে। অন্যান্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোও ঘটনাটি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে, যার ফলে এই উত্তেজনা দ্রুত অন্যত্র ছড়িয়ে পড়তে পারে।”
বিশ্লেষকদের মতে, এই ঘটনায় শুধু ভারত-মিয়ানমার সম্পর্ক নয়, বরং সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারতের ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা নতুন করে উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে এই উত্তেজনা আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও মানবাধিকার পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।