নিউইয়র্ক সিটির আসন্ন মেয়র নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন নিশ্চিত করেছেন জোহরান মামদানি—একজন মুসলিম, তরুণ, প্রগতিশীল ও স্পষ্টভাষী রাজনীতিক। চলতি বছরের ২৪ জুন অনুষ্ঠিত ডেমোক্রেটিক প্রাইমারিতে তিনি নিউইয়র্কের সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুয়োমোসহ এক ডজন হেভিওয়েট প্রার্থীকে পরাজিত করে চমক জাগিয়েছেন। সরকারিভাবে চূড়ান্ত ফল ঘোষণা বাকি থাকলেও তার জয় প্রায় নিশ্চিত ধরা হচ্ছে। এই বিজয়ে শুধু নিউইয়র্ক নয়, আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠেছে বিশ্বজুড়ে প্রবাসী ও প্রগতিশীল জনগণ।
জোহরান মামদানি কে?
জোহরান কোয়ামে মামদানি জন্মগ্রহণ করেন উগান্ডার কাম্পালায়। তার পিতা বিখ্যাত আফ্রিকান পণ্ডিত মাহমুদ মামদানি এবং মাতা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা মীরা নায়ার। মাত্র সাত বছর বয়সে নিউইয়র্কে চলে আসা মামদানি বেড়ে উঠেছেন শহরের বৈচিত্র্য ও সংগ্রামের মাঝেই।
তিনি পড়াশোনা করেছেন আফ্রিকানা স্টাডিজে। পেশাজীবনের শুরুতে কাজ করেছেন একটি হাউজিং অর্গানাইজেশনে, যেখানে দরিদ্র পরিবারদের উচ্ছেদ ঠেকাতে ভূমিকা রেখেছেন।
বর্তমানে ৩৩ বছর বয়সী মামদানি নিউইয়র্ক স্টেট অ্যাসেম্বলিতে ডিস্ট্রিক্ট ৩৬-এর প্রতিনিধিত্ব করছেন এবং এটি তার টানা তৃতীয় মেয়াদ।
সম্প্রতি তিনি বিয়ে করেছেন সিরীয় শিল্পী রামা দুওয়াজিকে, যিনি দ্য নিউইয়র্কার, ওয়াশিংটন পোস্ট এবং ভাইস-এর মতো আন্তর্জাতিক মাধ্যমে তার শিল্পকর্মের জন্য প্রশংসিত।
গাজা যুদ্ধ ও ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে সাহসী অবস্থান
গাজায় ইসরায়েলি হামলা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে জোহরান মামদানি সবসময়ই দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন। গত অক্টোবরে তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন—“ইসরায়েল গণহত্যা চালাচ্ছে।” তিনি বিডিএস আন্দোলনের দৃঢ় সমর্থক এবং ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি একনিষ্ঠ।
ডিসেম্বরে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যদি নিউইয়র্কে আসে, আমি তাকে গ্রেফতার করব।”
‘গ্লোবালাইজ দ্য ইন্তিফাদা’ স্লোগানের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করায় সমালোচনার মুখেও পড়েন, তবে মামদানি স্পষ্টভাবে জানান, “একজন মুসলিম হিসেবে আমি জানি কীভাবে আরবি শব্দ বিকৃত করা হয়, অথচ এটি নিপীড়িতদের প্রতি সংহতির প্রতীক।”
তার এসব অবস্থান তাকে ইসলামবিদ্বেষী হুমকির লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে, কিন্তু তিনি বারবার বলেছেন, তার সমালোচনার লক্ষ্য ইহুদি জনগণ নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল সরকারের নীতিমালা।
কিভাবে জয় পেলেন মামদানি?
নিউইয়র্কের নির্বাচনী ইতিহাসে মামদানির এই জয় প্রথা ভেঙেছে। মারিস্ট পোলসহ বেশ কিছু জরিপে দেখা যাচ্ছিল—অ্যান্ড্রু কুয়োমো এগিয়ে রয়েছেন। কিন্তু র্যাঙ্কড-চয়েস ভোটিং সিস্টেমের কারণে শেষ মুহূর্তে বদলে যায় সমীকরণ।
প্রচারণা ছিল স্বল্প বাজেটের, কিন্তু কৌশল ছিল পরিপূর্ণ। তরুণ স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে গড়ে উঠেছিল তার নির্বাচনী বাহিনী। ডিজিটাল মিডিয়া, সৃজনশীল কনটেন্ট ও ব্যক্তিগত সংযোগে গড়ে তুলেছেন এক আবেগঘন এবং তৃণমূলকেন্দ্রিক প্রচারাভিযান।
প্রাইমারির কয়েকদিন আগে পুরো ম্যানহাটন জুড়ে পায়ে হেঁটে প্রচারণা চালিয়েছেন মামদানি। পথে পথে সাধারণ ভোটারের সঙ্গে সেলফি তুলেছেন, কথোপকথনে সময় দিয়েছেন। এই সরাসরি সংযোগ তার প্রতি গড়ে তোলে গণমানুষের ভালোবাসা।
তিনি একবার তার দাদীকে সঙ্গে নিয়ে একটি র্যাপ ভিডিও বানিয়েছিলেন এবং সেটি প্রচারণায় ব্যবহারের মাধ্যমে ডিজিটাল মিডিয়ায় তুমুল সাড়া ফেলেন।
তাকে সমর্থনকারী এক তরুণ লোকমণি রাই বলেন—“জোহরান হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবক আর লক্ষ লক্ষ দাতার মাধ্যমে চালিত হচ্ছেন। স্থানীয় নির্বাচনে এ ধরনের স্বতঃস্ফূর্ত তৃণমূল আন্দোলন বিরল।”
‘জনগণের মেয়র’
জোহরান মামদানি নিউইয়র্কবাসীর কাছে এখন ‘জনগণের মেয়র’ উপাধিতে পরিচিত হয়ে উঠছেন। তার রাজনীতি কেবল নীতিভিত্তিক নয়, বরং আন্তরিক ও হৃদয়গ্রাহী।
তিনি মূলধারার ডেমোক্রেটদের বাইরে গিয়ে গড়ে তুলেছেন এক প্রগতিশীল ফ্রন্ট—যেখানে স্থান পেয়েছে হাউজিং রিফর্ম, পরিবেশবান্ধব নগরায়ন, অভিবাসীদের অধিকার, পুলিশের জবাবদিহিতা এবং বৈশ্বিক ন্যায়বিচার।
জয় যদি আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত হয়, তবে জোহরান মামদানি হবেন নিউইয়র্ক সিটির ইতিহাসে প্রথম মুসলিম এবং প্রথম দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত মেয়র—যার শিকড় আফ্রিকা, ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যের মাটি ছুঁয়ে আছে।
এই বিজয় শুধু এক রাজনীতিকের নয়, বরং এটি একটি আদর্শ, একটি প্রজন্ম, একটি পরিবর্তনের গল্প—যা লিখছে নিউইয়র্কের ভবিষ্যত ইতিহাস।