যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেন বুধবার একটি বহুপ্রতীক্ষিত “অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি” স্বাক্ষর করেছে, যার অধীনে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের দুর্লভ খনিজ ও গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদে প্রবেশাধিকার পাবে। এই বিনিময়ে, ইউক্রেনের পুনর্গঠন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য একটি যৌথ বিনিয়োগ তহবিল গঠন করা হবে, যেখানে উভয় পক্ষই সমান অংশীদার থাকবে।
চুক্তিটি এমন এক সময় স্বাক্ষরিত হলো যখন ইউক্রেন রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করছে এবং যুক্তরাষ্ট্র তার সমর্থনে ইতোমধ্যেই ১২৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি সহায়তা দিয়েছে। তবে এই চুক্তিটি মূলত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের অধীনে বাস্তবায়িত হয়েছে, যিনি ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে চুক্তিটি গুরুত্বের সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যান।
✅ চুক্তির মূল শর্ত ও কাঠামো:
- বিরল খনিজের অ্যাক্সেস: যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের ভূগর্ভস্থ দুর্লভ ও কৌশলগত খনিজ সম্পদের প্রকল্পে সরাসরি বিনিয়োগ ও খনন অধিকার পাবে। এসব খনিজ আধুনিক প্রযুক্তি (যেমন সেমিকন্ডাক্টর, ব্যাটারি, ড্রোন) ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জামে ব্যবহার হয়।
- ইউক্রেনের পূর্ণ মালিকানা বজায় থাকবে: ইউক্রেনের অর্থনীতি মন্ত্রী ইউলিয়া সভিরিডেনকো নিশ্চিত করেছেন, সমস্ত খনিজ সম্পদের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ ইউক্রেনের হাতে থাকবে। “আমাদের ভূখণ্ড ও জলসীমায় থাকা সম্পদ আমাদেরই,” তিনি এক্স-এ পোস্ট করেন।
- যৌথ বিনিয়োগ তহবিল: এই তহবিলে সমান পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেন, এবং তহবিলের পরিচালনায় উভয় দেশের সমান কর্তৃত্ব থাকবে।
- পূর্বের সহায়তা গণ্য হবে না: ইউক্রেনের প্রধানমন্ত্রী দেনিস শ্মিহাল বলেন, এই চুক্তি ২০২২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ইউক্রেনকে যে সহায়তা দেওয়া হয়েছে তা গণ্য করবে না। শুধুমাত্র নতুন সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা এই বিনিয়োগ তহবিলে অন্তর্ভুক্ত হবে।
🛑 আলোচনার বাধা ও বিতর্ক:
চুক্তিটি বাস্তবায়নের পথে একাধিকবার বিতর্ক ও জটিলতা সৃষ্টি হয়েছিল। একটি বড় বাধা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা — ইউক্রেন শুরুতে চেয়েছিল চুক্তির অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র তার সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আনুষ্ঠানিক নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতি দিক। ট্রাম্প প্রশাসন তা তখন প্রত্যাখ্যান করে।
ফেব্রুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি যখন হোয়াইট হাউসে যান, তখন এই চুক্তি স্বাক্ষরের কথা ছিল, কিন্তু ওভাল অফিসে উত্তপ্ত বৈঠকের কারণে সফর সংক্ষিপ্ত হয়ে যায় এবং চুক্তি স্থগিত হয়। এরপর ট্রাম্প সাময়িকভাবে ইউক্রেনের জন্য সব মার্কিন সহায়তা স্থগিত করে দেন, যা ইউরোপীয় দেশগুলোকে উদ্বিগ্ন করে তোলে।
🌍 ভূরাজনৈতিক ও কৌশলগত প্রভাব:
এই চুক্তি কেবল অর্থনৈতিক অংশীদারত্বই নয়, বরং পশ্চিমা বিশ্বের জন্য চীনের বিকল্প খনিজ সরবরাহ নিশ্চিত করতেও গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বে বিরল খনিজ উৎপাদনে চীনের একচেটিয়া আধিপত্য রয়েছে — এই প্রেক্ষাপটে ইউক্রেন একটি সম্ভাব্য বিকল্প সরবরাহকারী হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
ট্রাম্প এই চুক্তিকে “পেমেন্ট ফর প্রটেকশন” হিসেবে বর্ণনা করেছেন এবং বলেন, “আমরা আজ এমন একটি চুক্তি করেছি, যার মাধ্যমে আমরা হয়ত ৩৫০ বিলিয়ন ডলারের চেয়েও বেশি ফিরে পেতে পারি।”
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট বলেন, “এই চুক্তি স্পষ্টভাবে বার্তা দিচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র একটি স্বাধীন, নিরাপদ এবং সমৃদ্ধ ইউক্রেন গঠনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যেসব ব্যক্তি বা রাষ্ট্র রাশিয়ার যুদ্ধযন্ত্রে অর্থ বা অস্ত্র সরবরাহ করেছে, তারা পুনর্গঠনের সুযোগ পাবে না।”
🪨 ইউক্রেনের খনিজ সম্পদের গুরুত্ব:
ইউক্রেনের মাটিতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ অনুযায়ী ২২টি গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পাওয়া যায়, যার মধ্যে রয়েছে:
- রেয়ার আর্থ এলিমেন্টস (REEs)
- লিথিয়াম
- কোলবাল্ট
- গ্রাফাইট
- টাইটেনিয়াম
এসব উপাদান ইলেকট্রনিক্স, ব্যাটারি, সবুজ জ্বালানি এবং প্রতিরক্ষা প্রযুক্তিতে অপরিহার্য।
এই চুক্তির ফলে ইউক্রেন তার খনিজ সম্পদে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারবে এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে পুনর্গঠনের সুযোগ পাবে, একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত উৎসে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করল।