সৌদি আরবে নারীদের জন্য গড়ে ওঠা তথাকথিত ‘পুনর্বাসন কেন্দ্র’— বিশেষ করে দার আল-রেয়া— আদতে নারীদের শাস্তি, দমন ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণের এক ভয়ঙ্কর যন্ত্র বলে মনে করছেন বহু সাবেক বন্দিনী ও মানবাধিকারকর্মী। এই কেন্দ্রগুলোর ভেতরে যা ঘটে, তা যেন সৌদি আরবের আলোচনার বাইরের এক নৃশংস বাস্তবতা। ঘর থেকে বের হওয়া, প্রেমে জড়ানো, অথবা পরিবারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিলেই তরুণী বা নারীকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় এসব কেন্দ্রে। আর একবার ঢুকে গেলে সেখান থেকে মুক্তির পথ অত্যন্ত সীমিত— হয় কোনো পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি, নয়তো বিয়ে অথবা আত্মহনন।
এমনই এক চিত্র উঠে এসেছে দ্য গার্ডিয়ানের হাতে আসা একটি ভিডিওতে, যেখানে দেখা গেছে উত্তর-পশ্চিম সৌদি আরবের একটি ভবনের জানালার কার্নিশে দাঁড়িয়ে এক তরুণী আত্মহত্যার চেষ্টা করছেন। পরে তাকে ক্রেন দিয়ে নামানো হয়। ওই তরুণী দার আল-রেয়াতে বন্দী ছিলেন বলে দাবি করা হচ্ছে।
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, এসব কেন্দ্রে নামমাত্র ‘পুনর্বাসনের’ আড়ালে চলে লাগাতার নির্যাতন। সপ্তাহব্যাপী বেত্রাঘাত, জোর করে ধর্মীয় শিক্ষা, বাইরের জগত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে রাখা এবং বছরব্যাপী বন্দিত্ব— সবই চালু আছে সেখানে। বন্দিনীদের নাম ধরে ডাকা হয় না, নম্বরে চিহ্নিত করা হয়। কেউ নামাজ না পড়লে, অন্য বন্দিনীর সঙ্গে একা কথা বললে, অথবা নিজের পরিচয় জানালে তাকে ‘সমকামী’ আখ্যা দিয়ে নির্মমভাবে মারধর করা হয়।
২৫ বছর বয়সী আমিনা নিজের পরিবার থেকে পালিয়ে আশ্রয় নিতে গিয়েছিলেন বুরাইদাহর একটি কেন্দ্রের দ্বারে। কিন্তু সেই কেন্দ্রের পরিবেশই ছিল এমন যে পরদিনই তার বাবাকে ডেকে পাঠানো হয়। সেখানে সই করাতে বলা হয় এমন এক চুক্তিতে, যেখানে বলা হয় তিনি বাইরে যেতে পারবেন না, সর্বদা পুরুষ অভিভাবকের সঙ্গে থাকতে হবে, এবং পরিবারের আদেশ মানতে হবে। সই করার পর বাড়ি ফিরে আবারও নির্যাতনের মুখে পড়েন আমিনা, শেষ পর্যন্ত তাকে দেশ ত্যাগ করতেই হয়।
১৬ বছর বয়সী শামস জানান, এক নারী বন্দিনী একবার তাদের স্কুলে এসে নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, প্রেমে জড়ানোর পর গর্ভবতী হয়ে পড়ায় পরিবার তাকে ত্যাগ করে এবং দার আল-রেয়াতে পাঠায়। সেই নারীর বক্তব্য ছিল, “মেয়েরা যদি একবার সম্পর্ক গড়ে তোলে, সমাজের চোখে তারা আজীবন সস্তা হয়ে যায়।”
আরেক তরুণী লায়লা পরিবারিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে থানায় গিয়ে উল্টো ‘পরিবারের সম্মানহানি’র অভিযোগে নিজেই বন্দী হন পুনর্বাসন কেন্দ্রে।
অধিকারকর্মীরা বলছেন, এসব কেন্দ্র থেকে মুক্তি পেতে হলে নারীকে হয় বিয়ে করতে হয়, নয়তো পুরুষ অভিভাবকের সম্মতি পেতে হয়, আর না হয় জীবন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে হয়— আত্মহত্যার মাধ্যমে। অভিযোগ রয়েছে, অনেক সময় প্রবীণ পুরুষ বা সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীরাও এই কেন্দ্রগুলোতে এসে নারী খুঁজে নেয় স্ত্রী হিসেবে।
প্রবাসী মানবাধিকারকর্মী ফাওজিয়া আল-ওতাইবি বলেন, “এই স্থানগুলো নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে না, কেউ সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখে না। এইসব কেন্দ্রে নারীরা যেন সমাজ থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়।”
মানবাধিকার সংগঠন ALQST এই কেন্দ্রগুলোর কার্যক্রমকে সৌদি সরকারের নারী ক্ষমতায়নের ঘোষিত নীতির সম্পূর্ণ বিপরীত বলে আখ্যা দিয়েছে। সংগঠনটির কর্মকর্তা নাদিন আবদুল আজিজ বলেন, “যদি নারীর অধিকার উন্নয়ন সত্যিই সরকারের উদ্দেশ্য হতো, তাহলে এই ধরনের বৈষম্যমূলক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে প্রকৃত নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করত।”
সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। এক সরকারি মুখপাত্র দাবি করেছেন, এসব প্রতিষ্ঠান আটক কেন্দ্র নয় এবং নারীরা ইচ্ছেমতো বাইরে যেতে ও কেন্দ্রে না থাকার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তিনি আরও বলেন, যদি নির্যাতনের কোনো অভিযোগ আসে, সেটি গুরুত্বসহকারে তদন্ত করা হয়।
তবে বাস্তব অভিজ্ঞতা ও নির্যাতিতাদের কণ্ঠে ফুটে ওঠা চিত্র স্পষ্ট করে যে, সৌদি সমাজে নারীদের স্বাধীনতার লড়াই এখনো রুদ্ধ এক গলিপথে আটকে আছে। পুনর্বাসনের নামে এই কেন্দ্রে যা চলে, তা বাস্তবে মধ্যযুগীয় মানসিকতারই আধুনিক সংস্করণ— যেখানে নারীর স্বাধীন ইচ্ছা নয়, পুরুষতান্ত্রিক ‘শৃঙ্খলা’ই চূড়ান্ত নিয়ামক।