বিশ্বব্যাপী অস্থিরতা ও রাশিয়ার আগ্রাসনের প্রেক্ষাপটে যুক্তরাজ্যকে ‘যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত’ করার ঘোষণা দিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার। ২ জুন স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে দেওয়া এক ভাষণে তিনি বলেন, এখনকার বৈশ্বিক হুমকি স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর ও অনিশ্চিত। সংঘাত প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া—এই নীতিকে সামনে রেখেই স্টারমার তার প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন।
তিনি বলেন, ইউরোপে সরাসরি যুদ্ধ, পারমাণবিক হুমকি, প্রতিনিয়ত সাইবার হামলা এবং ব্রিটিশ জলসীমা ও আকাশসীমায় রুশ সামরিক তৎপরতা—এই সবকিছুই যুক্তরাজ্যের নিরাপত্তাকে নতুনভাবে ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাজ্যের সামরিক খাতে বড় ধরনের বিনিয়োগের ঘোষণা দেন তিনি।
প্রতিরক্ষা পরিকল্পনায় উল্লেখযোগ্য কয়েকটি পদক্ষেপ হচ্ছে: ১২টি নতুন আক্রমণাত্মক সাবমেরিন নির্মাণ, পারমাণবিক অস্ত্র ও গোলাবারুদে বিলিয়ন পাউন্ডের বিনিয়োগ, সাত হাজার দূরপাল্লার অস্ত্র সংগ্রহ, নতুন সাইবার কমান্ড গঠন, ডিজিটাল নিরাপত্তা সক্ষমতায় এক বিলিয়ন পাউন্ড ব্যয়, ড্রোন প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং গোলাবারুদ মজুত বৃদ্ধি। সেনাবাহিনীর সদস্যদের আবাসন ব্যবস্থার উন্নয়নেও বরাদ্দ থাকছে অতিরিক্ত ১.৫ বিলিয়ন পাউন্ড।
স্টারমার জানিয়েছেন, এসব খরচ ধাপে ধাপে জিডিপির ২.৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হবে, যার অর্থের একটি অংশ বিদেশি সাহায্যের বাজেট কমিয়ে সরবরাহ করা হবে। তবে তিনি জিডিপির ৩ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করেননি।
যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে গঠিত নিরাপত্তা জোট ‘এইউকেইউএস’-এর অংশ হিসেবে যুক্তরাজ্য নতুন সাবমেরিন নির্মাণ করে ইউরো-আটলান্টিক অঞ্চলে নিজের প্রতিরোধ কৌশলকে ঢেলে সাজাতে চায়। চীনের ক্রমবর্ধমান সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবিলায় এই পদক্ষেপ সহায়ক হবে বলে সরকারের আশা।
প্রতিরক্ষা কৌশল পর্যালোচনার দায়িত্বে থাকা সাবেক ন্যাটো মহাসচিব জর্জ রবার্টসনের সুপারিশে যুক্তরাজ্য পারমাণবিক অস্ত্রবাহী যুদ্ধবিমান কেনার বিষয়টি বিবেচনায় নিচ্ছে, যা আমেরিকার পারমাণবিক ছায়ানির্ভরতা কমানোর লক্ষণ হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও লিবারেল ডেমোক্র্যাট এমপি মাইক মার্টিন মন্তব্য করেছেন, যুক্তরাজ্য এখন আর সম্পূর্ণভাবে যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভর করতে পারছে না, এবং নিজস্ব পারমাণবিক সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ তারই প্রতিফলন। স্টারমারের এই প্রতিরক্ষা কৌশল ঘোষণার সময়টিও তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ ইউক্রেনের ড্রোন হামলায় রাশিয়ার একটি বিমানঘাঁটি আক্রান্ত হওয়ার কিছু ঘণ্টার মধ্যেই তিনি এই ঘোষণা দেন।
বিশ্লেষকদের মতে, স্টারমারের এ পরিকল্পনা শুধু যুক্তরাজ্যের সামরিক শক্তিকে আধুনিক করার দিকেই নয়, বরং একটি নতুন ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার দিকেও ইঙ্গিত করে—যেখানে ইউরোপীয় দেশগুলোকে ক্রমশ নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের ছায়া থেকে কিছুটা সরে এসে।