চলমান ইরান-ইসরাইল সংঘাতের উত্তাপ যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এমন এক সংকটময় মোড়ে দাঁড়িয়ে, যেখানে তার সামনে রয়েছে দুটি পথ—একটি কূটনৈতিক সমঝোতার, আরেকটি সরাসরি সামরিক হামলার, যা ইচ্ছাকৃত যুদ্ধের শামিল। ইউরোপীয় পররাষ্ট্র বিষয়ক কাউন্সিলের জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক এলি জেরানমায়েহ এই পরিস্থিতিকে বলেছেন ‘প্যান্ডোরার বাক্স’—একবার খুলে গেলে যার পরিণতি কেউই আগে থেকে অনুমান করতে পারবে না।
তিনি মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, “এই ধরনের সংকটে একজন নেতা সবসময়ই একটি বিকল্প রাখতে পারেন। অতীতেও আমরা দেখেছি, ট্রাম্প যুদ্ধের দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরে এসেছেন। এবারও সেটা সম্ভব।” তবে তিনি কড়া সতর্কবার্তাও উচ্চারণ করেন—যদি ট্রাম্প ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর সরাসরি হামলা চালান, তাহলে ইরান একে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা হিসেবে বিবেচনা করবে এবং প্রতিক্রিয়া হবে ভয়াবহ।
‘প্যান্ডোরার বাক্স’ বলতে বোঝানো হচ্ছে এমন একটি বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত, যার ফলাফল হবে অনিয়ন্ত্রিত, অপ্রত্যাশিত এবং ধ্বংসাত্মক। গ্রিক পুরাণে প্যান্ডোরা ছিলেন সেই নারী যিনি এক নিষিদ্ধ বাক্স খুলে ফেলেন, আর তার ফলে পৃথিবীতে নেমে আসে যুদ্ধ, রোগ, দুঃখ আর মৃত্যু। সেই বাক্সে শুধু একটি জিনিসই থেকে যায়—‘আশা’। আধুনিক রাজনীতি ও যুদ্ধনীতি বিশ্লেষণে এই রূপক ব্যবহার করা হয় এমন পরিস্থিতির জন্য, যেখানে একবার পদক্ষেপ নিলে তা থামানো সম্ভব নয়, এবং ফলাফল ছড়িয়ে পড়ে বহু দিক দিয়ে।
বিশ্লেষক জেরানমায়েহ বলেন, যদি যুক্তরাষ্ট্র ইরানে সরাসরি হামলা শুরু করে, তাহলে এই সংঘাত ছড়িয়ে পড়বে পুরো মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে। এটি শুধু ইরান-ইসরাইল নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, হিজবুল্লাহ, ইরাকি মিলিশিয়া, এমনকি রাশিয়া ও চীনকেও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে ফেলবে।
তিনি সতর্ক করেন, এই যুদ্ধ যদি শুরু হয়, তাহলে সেটা সম্ভাব্যভাবে ট্রাম্পের গোটা প্রেসিডেন্সি গ্রাস করে ফেলবে। কারণ, ইরান আত্মসমর্পণ করবে না। তারা জানে তারা সামরিকভাবে জয়ী হতে পারবে না, কিন্তু তারা এমন এক যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করবে, যেখানে কেউ বিজয়ী হবে না—সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সংঘাত হবে দীর্ঘস্থায়ী, রক্তক্ষয়ী, এবং তা পুরো বিশ্বে প্রতিধ্বনি তুলবে।
বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে যে উত্তেজনা চলছে, তা শুধু একটি সীমান্ত সংঘর্ষ নয়। গত ছয় দিনে ইসরাইল তেহরানে বিমান হামলা চালিয়েছে, পাল্টা জবাবে ইরান ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করেছে। পরিস্থিতি ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি নজরে রয়েছে হোয়াইট হাউস। কারণ, ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইরানের ‘নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ’-এর দাবি করে বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন, এবং তার ঘনিষ্ঠ সামরিক উপদেষ্টারা একটি সীমিত পাল্টা হামলার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনায় বসেছেন।
বিশ্বব্যাপী কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এখন ট্রাম্প যেকোনো সিদ্ধান্ত নিলেই তা বিশ্ব রাজনীতির দিক নির্ধারণ করে দেবে। যদি তিনি হামলা চালান, তাহলে মধ্যপ্রাচ্য আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে। তেলের বাজারে হাহাকার দেখা দেবে, বিশ্বজুড়ে অভিবাসন সংকট বাড়বে, এবং সন্ত্রাসবাদের হুমকি ছড়িয়ে পড়বে ইউরোপ ও আমেরিকায়। এমনকি জাতিসংঘ বা ন্যাটোর পক্ষ থেকেও বড় কোনো প্রতিক্রিয়া আসতে পারে।
এই মুহূর্তে, ‘শান্তি না যুদ্ধ’—এই এক প্রশ্ন ঘিরেই গোটা বিশ্ব শ্বাসরুদ্ধ অপেক্ষায়। ট্রাম্প যদি ‘প্যান্ডোরার বাক্স’ খুলে ফেলেন, তাহলে আগামী সপ্তাহ নয়, পুরো দশকজুড়ে তার প্রতিধ্বনি বিশ্বকে তাড়া করে ফিরবে।