দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ব রাজনীতিতে ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ককে মনে করা হতো একটি অবিচ্ছেদ্য মৈত্রী। ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ছিল ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় ও নির্ভরযোগ্য মিত্র। কিন্তু গাজা যুদ্ধকে ঘিরে বর্তমান ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সেই সম্পর্কেই দেখা দিয়েছে নজিরবিহীন টানাপোড়েন। আর এই পরিবর্তনের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ‘এক্সজিও নিউজ’ জানিয়েছে, গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর গণহত্যা ও মানবিক বিপর্যয় দেখে ট্রাম্প ক্ষুব্ধ। তিনি যুদ্ধ অবিলম্বে বন্ধের আহ্বান জানিয়ে নেতানিয়াহুর কর্মকাণ্ডে স্পষ্ট বিরাগ প্রকাশ করেছেন। এমনকি তাঁর সাম্প্রতিক মধ্যপ্রাচ্য সফরে ইসরায়েলকে এড়িয়ে যাওয়া এবং নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠকে অনীহা—সব কিছু মিলিয়ে ট্রাম্পের অবস্থান এখন অনেকটাই ভিন্ন পথে।
‘দা হিল’-এর বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ইসরায়েলকে ‘ব্ল্যাংক চেক’ দেওয়ার মার্কিন নীতি থেকে সরে আসার প্রবণতা এখন স্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্র চাইছে না, নেতানিয়াহুর যুদ্ধকামী ও আগ্রাসী রাজনীতির দায় তারা বহন করুক। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ট্রাম্পের এই মনোভাবের নেপথ্যে রয়েছে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত এবং রাজনৈতিক কারণ।
প্রথমত, গাজায় চলমান যুদ্ধকে ট্রাম্প মনে করছেন নেতানিয়াহুর ‘রাজনৈতিক বাঁচার লড়াই’। দ্বিতীয়ত, ইসরায়েলের ওপর মার্কিন অর্থনীতি নির্ভরশীল নয়—এই বাস্তবতায় ওয়াশিংটন এখন বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে নিজস্ব জাতীয় স্বার্থকে। তৃতীয়ত, মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত বিন্যাসে ইসরায়েলকে কেন্দ্র করে নয়, বরং সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বৃহত্তর মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ার কৌশলেই গুরুত্ব দিচ্ছে হোয়াইট হাউস।
এদিকে, ট্রাম্পের এই অবস্থান মার্কিন রিপাবলিকান পার্টির ভেতরেও বিভক্তি তৈরি করেছে। দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলপন্থী লবিং গ্রুপ ‘AIPAC’ কংগ্রেসে প্রভাব বিস্তার করলেও, এখন রিপাবলিকানদের একাংশ নেতানিয়াহুর যুদ্ধনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন। এতে ইসরায়েলের একচ্ছত্র কূটনৈতিক সুবিধা এখন চ্যালেঞ্জের মুখে।
বিশ্লেষকদের ধারণা, যদি গাজা যুদ্ধ বন্ধ হয়ে যায় এবং যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন হ্রাস করে, তবে নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়বে। দীর্ঘদিনের গাজা দখলের যে স্বপ্ন তিনি পোষণ করে এসেছেন, সেটি এবার ভেঙে যেতে পারে মার্কিন নীতিগত অবস্থানের কারণেই।
বিশ্ব রাজনীতির এই নতুন মোড় ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এটি শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, বরং বৈশ্বিক কূটনৈতিক ভারসাম্যের ওপরও ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।