মানুষের কৌতুক ও তামাশার লক্ষ্য যে কেবল অন্য মানুষই নয়, তা বহুবার প্রমাণিত। নিরীহ প্রাণীরাও বারবার সেই হাসির খোরাকে পরিণত হয়েছে— কখনও প্রশংসার মোড়কে, আবার কখনও নিছক বিদ্রূপে। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির যুগে, এই ট্রলের অন্যতম শিকার হয়ে উঠেছে এক শান্তিপ্রিয় নিশাচর প্রাণী— সান্ডা।
মূলত মরু অঞ্চলের জীব হলেও বাংলাদেশে সান্ডার উপস্থিতি সীমিত ও দুর্লভ। তার অদ্ভুত গঠন, আঁশে মোড়া দেহ আর নিজেকে বলের মতো গুটিয়ে নেওয়ার স্বভাব তাকে কৌতুকপ্রিয় মানুষের নজরে এনে দিয়েছে এক ভিন্ন মাত্রায়। কিন্তু গত মে মাসে সিলেটে এক ব্যক্তির কোলের সান্ডার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর যে প্রবাহ তৈরি হয়, তা কেবল হাস্যরস ছিল না— ছিল বিকৃত কল্পনা, অশ্লীল ইঙ্গিত আর নোংরা রসবোধের এক অন্ধ আবেগ।
‘সান্ডা’ নামটি স্থানীয়, বৈজ্ঞানিক নাম Manis crassicaudata। এটি মূলত একটি ইন্ডিয়ান প্যাঙ্গোলিন, বাংলাদেশের বনরুই বা কাঁটাওয়ালা বনরুই নামেও পরিচিত। এরা স্তন্যপায়ী হলেও শরীর আবৃত কেরাটিনজাত আঁশে। নিশাচর, নিরীহ এবং আত্মরক্ষায় চুপচাপ গুটিয়ে যাওয়া এ প্রাণী মানুষের কল্পনায় কীভাবে যৌন প্রতীকে পরিণত হলো— সেটিই ভাবনার বিষয়।
এই দৃষ্টিভঙ্গির পেছনে রয়েছে বিকৃত মানসিকতা এবং ‘বিনোদনের’ নামে দায়িত্বহীন ইন্টারনেট ব্যবহার। এমন এক সমাজে আমরা পৌঁছেছি, যেখানে একটি নিরীহ প্রাণীর শারীরিক বৈশিষ্ট্যও বিকৃত রসিকতার পাত্র হয়ে ওঠে। সান্ডার ক্ষেত্রে এটি যেন রীতিমতো ‘সোশ্যাল হ্যারাসমেন্ট’ হয়ে দাঁড়ায়।
এটা নতুন কিছু নয়। এর আগে শ্লথ, ল্যামা, গাধা কিংবা উটের মতো প্রাণীরাও ট্রলের শিকার হয়েছে। শ্লথকে বলা হয়েছে ‘স্লো লাইফ আইকন’, ল্যামাকে ‘স্টুপিড বাট কিউট’, গাধাকে ‘মূর্খের প্রতীক’ আর উটকে ‘বুড়ো বদরাগী’। অথচ এসব প্রাণীর প্রতিটিই প্রকৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং নিজেদের মতো করেই টিকে আছে এই পৃথিবীতে।
তবু প্রশ্ন রয়ে যায়— আমরা কি এতটাই উদাসীন হয়ে পড়েছি যে, প্রাণীরাও আমাদের কৌতুক থেকে রেহাই পায় না? এই ট্রলগুলো কি শুধুই ‘মজা’? নাকি এগুলো আমাদের অন্তর্জালের নৈতিক অবক্ষয় ও সহানুভূতিহীনতা প্রকাশ করছে?
সান্ডা এখন কেবল একটি প্রাণীর নাম নয়। এটি আমাদের বিবেকের মুখোমুখি দাঁড় করানো এক প্রতিচ্ছবি। আমাদের রসবোধ, মূল্যবোধ আর সামাজিক উপলব্ধির দিকে আঙুল তোলে এই ট্রল-উন্মাদনা। প্রশ্ন জাগে— আমরা কি সত্যিই এতটা অমানবিক হয়ে উঠেছি?
এখনই সময়—পুনরায় ভাবার। হাস্যরসের নামে বোধহীনতা যদি প্রভাব ফেলতে শুরু করে জীবজগতের উপরও, তবে তার দায় সমাজ হিসেবে আমাদেরই নিতে হবে। সান্ডা হয়তো কিছু বলতে পারে না, তবে তার নিঃশব্দ প্রতিবাদ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, আমাদের রসবোধ কতটা পথ হারিয়েছে।