গ্রিনল্যান্ডের রাজনীতিবিদরা যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের সফর পরিকল্পনার নিন্দা জানিয়েছেন, যা দেশটির সার্বভৌমত্ব নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গ্রিনল্যান্ডকে যুক্তরাষ্ট্রের অংশ হিসেবে নেওয়ার বিষয়ে প্রকাশ্য আগ্রহের পরিপ্রেক্ষিতে এই সফরগুলোকে আক্রমণাত্মক হিসেবে দেখা হচ্ছে।
হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় মহিলা উষা ভ্যান্স চলতি সপ্তাহে গ্রিনল্যান্ডে একটি সাংস্কৃতিক সফরে যাচ্ছেন। এছাড়া ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়াল্টজের নেতৃত্বে আরেকটি সফর পরিকল্পিত রয়েছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি সচিব ক্রিস রাইটও থাকবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্প প্রশাসনের এই পরিকল্পনা কেবল ভূরাজনৈতিক কৌশলের অংশ, যা আন্তর্জাতিকভাবে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে।
গ্রিনল্যান্ডের বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী মুটে এগেদে এই সফর পরিকল্পনাকে ‘আগ্রাসী’ উল্লেখ করে বলেন, সফরকারী মার্কিন কর্মকর্তাদের কোনো আনুষ্ঠানিক বৈঠকের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। তিনি বলেন, “জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার গ্রিনল্যান্ড সফরের কোনো যৌক্তিকতা নেই। এটি শুধুমাত্র আমাদের প্রতি শক্তি প্রদর্শনের জন্য করা হচ্ছে।”
এদিকে, গ্রিনল্যান্ডের সম্ভাব্য পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী জেন্স-ফ্রেডরিক নিলসেন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের এই সফরকে ‘স্থানীয় জনগণের প্রতি অসম্মানজনক’ বলে অভিহিত করেছেন।
গ্রিনল্যান্ডে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ এবং বিরোধিতা
গ্রিনল্যান্ড বিশ্বের বৃহত্তম দ্বীপ, যা আর্কটিক ও আটলান্টিক মহাসাগরের মধ্যে অবস্থিত। প্রায় ৩০০ বছর ধরে এটি ডেনমার্কের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে। তবে পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতির ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কোপেনহেগেনের হাতে রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরেই গ্রিনল্যান্ডে সামরিক ও কৌশলগত আগ্রহ বজায় রেখেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই মার্কিন সামরিক ঘাঁটি সেখানে অবস্থান করছে। পাশাপাশি, ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে ধারণা করা হয়েছিল যে, গ্রিনল্যান্ডের বিরল খনিজ সম্পদে তার বিশেষ আগ্রহ ছিল।
ট্রাম্পের ছেলে ডোনাল্ড ট্রাম্প জুনিয়র ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে গ্রিনল্যান্ড সফর করেছিলেন, যা ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে দ্বীপটিতে বিশেষ নজরদারির ইঙ্গিত দেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক উদ্যোগ এবং প্রতিক্রিয়া
হোয়াইট হাউসের এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, দ্বিতীয় মহিলা উষা ভ্যান্স ঐতিহাসিক স্থান পরিদর্শন করবেন এবং গ্রিনল্যান্ডের জাতীয় কুকুরস্লেজ রেস ‘আভান্নাতা কিমুসসেরসু’-তে অংশ নেবেন। তার সফরসঙ্গীদের মধ্যে তার ছেলেও থাকবেন। সফরের উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রিনল্যান্ডের সংস্কৃতি ও ঐক্য উদযাপনের কথা বলা হয়েছে।
তবে, ওয়াল্টজের সফরকে ঘিরে বিতর্ক আরও গভীর হয়েছে। নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিনি জ্বালানি সচিব ক্রিস রাইটের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি স্বার্থের বিষয়ে আলোচনার জন্য দ্বীপটি পরিদর্শন করবেন।
বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী এগেদে এই সফর পরিকল্পনাকে ‘প্ররোচনামূলক’ আখ্যা দিয়ে বলেছেন, এটি কেবল শক্তি প্রদর্শনের জন্য করা হচ্ছে।
এদিকে, ট্রাম্পের সাম্প্রতিক মন্তব্য আরও বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। ন্যাটো মহাসচিব মার্ক রুটের সঙ্গে এক আলোচনায় ট্রাম্প বলেন, “আপনি জানেন, মার্ক, আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য আমাদের এটি দরকার। আমাদের কয়েকজন প্রিয় খেলোয়াড় উপকূলের আশেপাশে ঘুরছে, তাই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।”
এই মন্তব্যের ফলে গ্রিনল্যান্ডের রাজনৈতিক দলগুলো একযোগে বিবৃতি দিয়ে ট্রাম্পের “অগ্রহণযোগ্য আচরণ” এর নিন্দা জানিয়েছে।
সাম্প্রতিক নির্বাচনেও যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। নির্বাচনে বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী এগেদের ইনুইট আতাকাতিগিত পার্টি পরাজিত হয়েছে এবং বিজয়ী হয়েছে নিলসেনের ডেমোক্র্যাটিক পার্টি, যা ধীরে ধীরে ডেনমার্ক থেকে স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে।
অপরদিকে, ট্রাম্প গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে এক ভাষণে বলেন, “আমি গ্রিনল্যান্ডের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রতি দৃঢ়ভাবে সমর্থন জানাই। যদি তোমরা চাও, আমরা তোমাদের যুক্তরাষ্ট্রে স্বাগত জানাই।”
তবে, গ্রিনল্যান্ডের ৮০% জনগণ ডেনমার্ক থেকে স্বাধীনতার পক্ষে হলেও, যুক্তরাষ্ট্রের অংশ হওয়ার সম্ভাবনাকে তারা আরও বেশি মাত্রায় প্রত্যাখ্যান করেছে বলে সাম্প্রতিক জরিপে উঠে এসেছে।