“আমরা কি যুদ্ধের দিকে যাচ্ছি?”—কায়রোর এক উদ্বিগ্ন বিক্রয়কর্মীর কণ্ঠে এই প্রশ্ন উঠে আসে যখন তিনি জানতে পারেন যে তিনি একজন সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলছেন।
ইসরায়েলের সাথে সম্ভাব্য যুদ্ধের এই গুঞ্জন মিশরের জনমনে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। একদিকে, দেশের দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক সংকট, অন্যদিকে গাজা ও লেবাননে ইসরায়েলের আক্রমণের দৃশ্য—এই দুইয়ের মিলিত প্রভাব জনগণকে যুদ্ধের সম্ভাবনা নিয়ে ভাবতে বাধ্য করছে।
সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাব—যেখানে তিনি গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক মিশরে পাঠানোর পরিকল্পনা করেছেন—এই বিতর্ককে আরও উসকে দিয়েছে।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন যে ইসরায়েল গাজা-মিশর সীমান্ত থেকে সেনা প্রত্যাহার করবে না। এই ঘোষণার পর থেকেই মিশরীয় এবং ইসরায়েলি গণমাধ্যমে উত্তেজনার পারদ চড়তে থাকে।
একটি ইসরায়েলি ওয়েবসাইটে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-নির্মিত এক ভিডিওতে মিশরের গুরুত্বপূর্ণ উচ্চ বাঁধ ধ্বংসের চিত্র দেখানো হয়। এর পাল্টা প্রতিক্রিয়ায়, একজন মিশরীয় ইউটিউবার ইসরায়েলের পারমাণবিক চুল্লিতে আক্রমণের একটি কল্পিত দৃশ্য তৈরি করেন।
এছাড়া সোশ্যাল মিডিয়া এবং টিভি আলোচনায় যুদ্ধের প্রস্তুতি সংক্রান্ত নানা ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে পড়ছে, যা আতঙ্ক আরও বাড়িয়ে তুলছে।
সীমান্তে সেনা মোতায়েন ও শান্তিচুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ
একটি বড় বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হলো সিনাই উপদ্বীপে মিশরের সেনা মোতায়েনের মাত্রা.
১৯৭৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত ইসরায়েল-মিশর শান্তিচুক্তি অনুযায়ী, সিনাইতে মিশরের সেনা উপস্থিতি সীমিত রাখা হয়েছে। তবে ২০১৬ সালে মিশর আইএস-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য ইসরায়েলের অনুমোদন নিয়ে সেখানে সেনা সংখ্যা বাড়ায়।সম্প্রতি মিশর সীমান্তে নতুন সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করছে, এমন দাবি করেছে ইসরায়েলের একাধিক কর্মকর্তা।ইসরায়েলের যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ইয়েচিয়েল লেইটার বলেন, “আমরা এমন ঘাঁটি দেখছি যা শুধুমাত্র আক্রমণাত্মক অভিযানের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি শান্তি চুক্তির গুরুতর লঙ্ঘন।”
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই তথ্য ভিত্তিহীন। মিশরীয় বিশ্লেষক হুসাম এল-হামালাউই বলেন, “কোনো মিশরীয় ট্যাঙ্ক ইসরায়েলের অনুমতি ছাড়া সিনাইতে প্রবেশ করতে পারে না। অধিকাংশ ভিডিও পুরনো বা ভিন্ন স্থানে ধারণ করা।”
যুদ্ধ কি আসন্ন?
মিশরের সামরিক কমান্ডার মেজর জেনারেল আহমদ মাহমুদ সাফি এল-দিন সম্প্রতি সৌদি সংবাদমাধ্যম আল-হাদাথকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমাদের সামরিক উন্নয়ন আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য, যুদ্ধের জন্য নয়।”ইসরায়েলের বিদায়ী সামরিক প্রধান হারজি হালেভি বলেছেন, “এই মুহূর্তে মিশর থেকে সরাসরি কোনো হুমকি নেই, তবে পরিস্থিতি মুহূর্তেই বদলে যেতে পারে।”
মিশরের জনপ্রিয় টিভি উপস্থাপক আমর আদিব তার শোতে বলেন, “এই মুহূর্তে আমরা ইসরায়েলের সাথে যুদ্ধে যাচ্ছি না, কিন্তু পরিস্থিতি দ্রুত বদলাতে পারে।”
তিনি সতর্ক করে বলেন, “যদি যুদ্ধ বাধে, ইসরায়েলও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মিশর যুদ্ধে নামলে লড়াই করতে প্রস্তুত।”
শান্তিচুক্তির ভবিষ্যৎ ও ট্রাম্পের প্রস্তাব
সাবেক মিশরীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী নাবিল ফাহমি বলেন, “শান্তিচুক্তির ওপর এত চাপ আগে কখনো পড়েনি।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি ইসরায়েল গাজার শরণার্থীদের মিশরে পাঠানোর চেষ্টা করে, তবে এটি মিশরের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠবে এবং শান্তিচুক্তি ভেঙে পড়তে পারে।২০২৪ সালে প্রেসিডেন্ট সিসি স্পষ্ট করে বলেন, “ফিলিস্তিনিদের মিশরে জোরপূর্বক পাঠানো হলে, মিশর ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়াবে।”
বর্তমানে যুদ্ধের কোনো সরাসরি আশঙ্কা নেই, তবে সীমান্তে উত্তেজনা ও রাজনৈতিক সংকট শান্তিচুক্তিকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, শান্তির স্বার্থে উভয় পক্ষকেই উত্তেজনা কমাতে হবে, নতুবা পরিস্থিতি দ্রুত জটিল হয়ে উঠতে পারে।